Last updated on April 2nd, 2021 at 03:25 pm

ভিটামিন সি স্বাস্থ্যের জন্য খুব প্রয়োজনিয় এক পুষ্টি উপাদান। ইহা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা থেকে শুরু করে হৃদরোগ, ত্বক কুচকে যাওয়া, গর্ভাবস্থায় শিশুর দেহ গঠন, চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষা – ইত্যাদির ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভিটামিন সি এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবেও কাজ করে। প্রাকৃতিকভাবে এই ভিটামিন বিভিন্ন খাদ্য যেমন ফলমুল ও শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। খাদ্যে সাপ্লিমেন্ট হিসাবেও বাজারে সহজলভ্য রয়েছে।

এই ভিটামিনের অপর নাম এল-এসকরবিক এসিড। এই আর্টিকেলে ভিটামিন সি এর উপর বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। যেমন, দেহের জন্য ভিটামিন সি কেন প্রয়োজন, এর অভাবজনিত লক্ষণসমুহ, দৈনিক কতটুকু খেতে হয়, ভিটামিন সি এর উপকারিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।

ভিটামিন সি আমাদের কেন প্রয়োজন?

ইহা পানিতে দ্রবনীয় ভিটামিনের মধ্যে একটি ভিটামিন। মানুষ তার শরীরে এই ভিটামিন তৈরি করতে পারেনা। তাই আমাদের দেহে এর প্রয়োজনীয় মাত্রা বজায় রাখার জন্য দৈনিক বাহির থেকে খাদ্য ও সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে ইহা গ্রহণ করতে হয়।

আমাদের শরীর বিভিন্ন কাজে ভিটামিন সি ব্যবহার করে। তার কয়েকটি উদাহারণ-

  • ইহা আমাদের শরীরে কোলাজেন (collagen) নামে এক ধরণের প্রোটিন, এল- ক্যারোটিন (L-carotine) নামের এমাইনো এসিড এবং কিছু নিউরোট্র্যান্সমিটার তৈরিতে কাজ করে।
  • এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে শরীরের বর্জ্য পদার্থ দেহ থেকে অপসারণে কাজ করে। এমন বর্জ পদার্থের একটি উদাহারন- reactive oxidative species, ROS.
  • দেহের ভিতর আয়রণ শোষণে ভূমিকা পালন করে।
  • ইহা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় ও জোরদার করে।
  • দেহের ক্ষতস্থান মেরামতে কাজ করে।

ROS হল free radicals বা মুক্ত পরমানু যা দেহের কোষের ভিতর বিপাকীয় কার্যক্রম সংগঠিত হওয়ার পর বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে তৈরি হয়। কোষের ভিতর বিপাক কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে আমাদের শরীরে শক্তি উৎপাদন হয় যা সার্বক্ষণিকভাবে একটি চলমান প্রক্রিয়া। কারণ, খাদ্য গ্রহনের পর দেহে শক্তি উৎপাদন না হলে আমাদের বেচে থাকা সম্ভব নয়।

এই free radicals হল বিপাক কার্যের ফসল যা দেহের ভিতর oxidative stress তৈরি করে দেহে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।

এছাড়া, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে,  ভিটামিন সি যে কোলাজেন নামের প্রোটিন তৈরি করে। এই প্রোটিন দেহের যোজক কলার (connective tissues) প্রধান উপাদান এবং ইহা ১-২% পরিমানে মাংসপেশীর মধ্যে বিদ্যমান থাকে।

কোলাজেন দেহের ফাইব্রাস টিস্যু তৈরির প্রধান উপাদান। ফাইব্রাস টিস্যু দিয়ে দেহের ভিতর যা তৈরি হয় তা নিম্নরুপ-

  • টেনডন যা পায়ের গোড়ালির উপরের অংশে থাকে।
  • লিগামেন্ট
  • ত্বক
  • চোখের কর্নিয়া
  • কার্টিলেজ
  • দেহের হাঁড়
  • পরিপাক তন্ত্র
  • রক্ত নালী

ভিটামিন সি এর অভাবে কি হয়?

শরীরে ভিটামিন সি এর পরিমান কমে গেলে স্কার্ভি (scurvy) নামের রোগ হয়। এই রোগের অন্যতম লক্ষণ হল, শরীরে হাঁড়ের জয়েন্ট ফুলে যায়, দাতে মাড়ি থেকে রক্ত বের হয়, দাত নরম হয়, রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং এক ধরণে ক্লান্তি অনুভব হয়।

ভিটামিন সি এর উৎস কি?

সাধারণত: ফলমুল ও শাক-সবজির মধ্যে এই ভিটামিন অধিক পরিমানে পাওয়া যায়।

যেসব ফলমুলে ইহা পাওয়া যায়-

  • লেবু
  • কমলা লেবু ও এর জুস
  • আঙ্গুর
  • কিউই (kiwi) ফল
  • আম
  • আনারস
  • তরমুজ
  • স্ট্রবেরি
  • পেপে
  • খরমুজ বা Cantaloupe
  • আমলকি

অপরদিকে যেসব সবজি এই ভিটামিন পাওয়া যায়-

  • কাঁচা মরিচ
  • ব্রোকলি
  • ফুলকপি ও পাতাকপি
  • পালন শাক ও অন্যান সবুজ পত্র বিশিষ্ট সবজি
  • মিষ্টি আলু ও গোল-আলু
  • টমেটো ও এর জুস
  • শালগম
  • মিষ্টি কুমড়া ও চাল কুমরা, ইত্যাদি।

এছাড়া, কিছু cereal জাতীয় খাদ্যেও ইহা পাওয়া যায়। অন্যান্য খাদ্য ও পানিয় এর মধ্যে অনেক সময় ভিটামিন সি fortify করা হয়। Fortify এর অর্থ হল যখন একটি খাদ্যের মধ্যে কোন ভিটামিন বা খনিজ লবন যোগ করা হয়, তাকে বুঝায়। কোন খাদ্য পণ্যের মোড়কে আপনি দেখতে পারেন সেখানে কি পরিমানে কোন প্রকারের ভিটামিন যোগ করা হয়েছে।

দৈনিক কতটুকু ভিটামিন সি খাওয়া প্রয়োজন?

যেকোন ভিটামিনের The Recommended Dietary Allowance (RDA) এর অর্থ হল দৈনিক ঐ ভিটামিন আপনার শরীরে দৈনিক কতটুকু প্রয়োজন হয় তা প্রকাশ করা।

কি পরিমানে ভিটামিন সি দৈনিক প্রয়োজন হতে পারে তা নির্ভর করে মানুষের বয়স এবং সেক্স এর উপর। অন্যান্য বিষয় যেমন গর্ভাবস্থা, অসুস্থতা ইত্যাদিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

ভিটামিন সি সহ অন্যান্য প্রয়োজনিয় ভিটামিনের দৈনিক চাহিদা পূরণে সর্বোত্তম পন্থা হল সুষম খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা যেখানে বিভিন্ন উৎসের সকল খাদ্য ও পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে।

নিচে ভিটামিন সি এর দৈনিক চাহিদা উল্লেখ করা হল:

Infants এর জন্য: সর্বোচ্চ মাত্রা:

  • জন্ম থেকে ৬ মাস বয়স হলে: দৈনিক ৪০ মিলিগ্রাম;
  • ৭ থেকে ১২ মাস বয়স হলে: দৈনিক ৫০ মিলিগ্রাম;

শিশুদের জন্য:

  • ১ থেকে ৩ বছর: দৈনিক ১৫ মিলিগ্রাম;
  • ৪ থেকে ৮ বছর: দৈনিক ২৫ মিলিগ্রাম;
  • ৯ থেকে ১৩ বছর: দৈনিক ৪৫ মিলিগ্রাম;

Adolescents:

  • ১৪ থেকে ১৮ বয়সের মেয়ে: দৈনিক ৬৫ মিলিগ্রাম;
  • গর্ভবতি কিশোরি মেয়ে: দৈনিক ৮০ মিলিগ্রাম;
  • বুকের দুধ দানকারি কিশোরি: দৈনিক ১১৫ মিলিগ্রাম;
  • ১৪ থেকে ১৮ বয়সের ছেলে: দৈনিক ৭৫ মিলিগ্রাম;

প্রাপ্ত বয়স্কের ক্ষেত্রে:

  • ১৯ এবং তদুর্ধ বয়সের পুরষ: দৈনিক ৯০ মিলিগ্রাম;
  • ১৯ এবং তদুর্ধ বয়সের মহিলা: দৈনিক ৭৫ মিলিগ্রাম;
  • গর্ভবতি মহিলা: দৈনিক ৮০ মিলিগ্রাম;
  • বুকের দুধ দানকারি মহিলা: দৈনিক ১২৫ মিলিগ্রাম

ধুমপায়িদের জন্য উপরে উল্লেখিত মাত্রার চেয়ে দৈনিক ৩৫ মিলিগ্রাম বেশি খেতে হবে।

ভিটামিন সি এর উপকারিতা কি?

ভিটামিন সি এর অনেক উপকারিতা আছে। তার মধ্যে গবেষণায় প্রমানিত এমন সাত ধরণের উপকার নিচে উল্লেখ করা হল।

১. জটিল দীর্ঘ মেয়াদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়:

ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ভিটামিন এক প্রকার শক্তিশালি এন্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করে এবং হৃদরোগ ও ক্যানসারসহ অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দুর করে।

২. হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে:

গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ উচ্চ রক্ত চাপে আক্রান্ত যা অনেক সময় স্ট্রোক ও হঠাৎ মৃত্যুর কারণ হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভিটামিন সি হাই ব্লাড প্রেসার কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখে।

প্রাণির উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তাকে ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট খাওয়ানোর ফলে তার রক্তনালী প্রসারন ঘটে। ফলে অধিক পরিমান রক্ত চলাচলের সুযোগ হয যা রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার জন্য সহায়ক হয়।

৩. হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে কাজ করে:

বিশ্বব্যাপী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলছে। অনেক ফ্যাক্টর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী, যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চ মাত্রায় ট্রাই গ্লিসারাইডের উপস্থিতি, হাই কোলেস্টেরল ইত্যাদি। এই ফ্যাক্টরগুলি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার বিষয়ে ভিটামিন সি এর সংশ্লিষ্টতার প্রমান বিভিন্ন গবেষণা ফলাফলে পাওয়া গিয়েছে।

৪. রক্তের ইউরিক এসিডের মাত্রা কমাতে কাজ করে:

রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার দ্বারা gout নামের একটি প্রতিরোধ করা যায়। Gout এমন এক রোগ যা দেহের অস্থিসন্ধিতে প্রদাহ তৈরি করে যার ফলে সেখানে খুব ব্যথার সৃষ্টি হয়। এই রোগের লক্ষণ তখন প্রকাশ পায় যখন রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা খুব বেশী হয়। ইউরিক এসিড হল দেহে তৈরি হওয়া এক বর্জ্য পদার্থ। রক্তে যখন এর পরিমান বেড়ে যায় তখন তা দেহের অস্থি সন্ধিতে গিয়ে জমা হয় এবং সেখানে দানা বাধে। ফলে শরীরের ঐ জয়েন্টগুলিতে প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং এতে খুব ব্যথা পাওয়া যায়।

বিভিন্ন গবেষণা ফলাফলে ভিটামিন সি রক্তে ইউরিক এসিড কমাতে কাজ করে বলে প্রমান পাওয়া যায়।

৫. শরীরে আয়রণের অভাব প্রতিরোধে কাজ করে:

আমরা জানি আয়রন দেহের জন্য খুব প্রয়োজনীয় এক পুষ্টি উপাদান। যা লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে এবং দেহের সর্বত্র অক্সিজেন সরবরাহে কাজ করে।

সাধারণত: উদ্ভিদজাত উৎসের আয়রণ আমাদের দেহে শোষণ হতে চায় না। আর, ভিটামিন সি উদ্ভিদজাত খাদ্যের মধ্যে বিদ্যমান আয়রন শোষনে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা যায়, ১০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খাওয়ার ফলে দেহে আয়রণ শোষণের হার ৬৭% এ উন্নীত হয়।

এভাবে ভিটামিন সি এনেমিয়া বা শরীরে রক্ত শূন্যতা দুরীকরণে ভূমিকা রাখে।

৬. দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করে:

শরীরের শ্বেত রক্ত কনিকার কাজ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে ইহা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদারকরণে ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, ত্বকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং ক্ষতস্থান মেরামতে এর ভূমিকা আছে।

৭. বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে স্মৃতি শক্তি ধরে রাখাতে কাজ করে:

Dementia এক ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে যা চিন্তা চেতন ও স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়ার সাথে সম্পর্কিত। সারা বিশ্বের প্রায় ৩৫ মিলিয়ন লোক বিশেষ করে যারা বয়স্ক তাদের অধিক হারে এই অবস্থার স্বীকার হতে দেখা যায়।

গবেষণা ফলাফলের সুপারীশ মতে, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে oxidative stress ও প্রদাহ সৃষ্টির ফলে dementia অবস্থায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ভিটামিন সি খুব শক্তিশালী প্রকারের এন্টি অক্সিডেন্ট হওয়ায় সেই ঝুঁকি দুর করতে সহায়তা করে।

উপরের উল্লেখিত উপকারিতাসমুহ গবেষণা ফলাফলে প্রমানিত। গবেষণায় প্রমানিত নয় ভিটামিন সি এর এমন কিছু উপকারিতা নিচে উল্লেখ করা হল-

  • দেহে সাধারণভাবে ঠান্ডা লাগার ক্ষেত্রে ইহা ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
  • ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে ব্যবহৃত হয়।
  • চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবহৃত হয়।
  • সীসা বিষক্রিয়ায় এটি কাজ করে বলে জানা যায়।

আরোও দেখুন-