ভিটামিন ডি একটি পুষ্টি উপাদান এবং একই সাথে এটি একটি হরমন। পুষ্টি উপাদান হওয়ার কারণে এর উৎস হিসাবে খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহন করার প্রয়োজনিয়তা রয়েছে। আবার, হরমন হওয়ার কারণে আমাদের শরীরের ভিতর এটিকে তৈরি করারও সক্ষমতা রয়েছে।

এর অপর নাম হল “sun shine” ভিটামিন। কারণ ইহা আপনার শরীরের চামড়ায় সূর্যালোকের সংষ্পর্শের কারণে তৈরি হয়। এছাড়াও, আপনি সুনির্দিষ্ট কিছু খাদ্য ও সাপ্লিমেন্ট গ্রহনের মাধ্যমেও ইহা পেতে পারেন। ইহা এমন ধরণের ভিটামিন যা চর্বিতে দ্রবনীয় হয়।

আমাদের শরীরের স্বাভাবিক সুস্থতায় এই ভিটামিনের ভূমিকা খুবই গুরত্বপূর্ণ। এর সবচেয়ে প্রধান কাজ হল পরিপাকতন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণে সহায়তা করা। শরীরে এর অভাব হলে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণ কাজ ব্যহত হয়। ফলে দেহের অস্থিমজ্জায় বা হার-হাড্ডি ও দাতের ভিতর নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়।

এছাড়াও, এর আরেকটি গুরত্বপূর্ণ কাজ হল দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। বিভিন্ন গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায়, ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা আছে।

এই আর্টিকেলে ভিটামিন ডি কত প্রকার, কিভাবে কাজ করে, এর উৎস কি কি,  দৈনিক কতটুকু ভিটামিন ডি গ্রহণ করা প্রয়োজন, ভিটামিন ডি এর কাজ, ভিটামিন ডি এর অভাবে কি হয়- ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে হবে।

ভিটামিন ডি কত প্রকার

ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহনের পর দেহের ভিতর এনজাইমেটিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সক্রিয়তা লাভ করে। তারপর শরীরের বিভিন্ন কোষের সাথে যুক্ত হয়ে খাদ্যের কি পরিমান ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণ করা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করে দেয়। পদ্ধতিটি উভয় প্রকার ভিটামিন ডি এর জন্য প্রযোজ্য।

ভিটামিন ডি দুই ধরণের হয়-

  • ভিটামিন ডি-২: এর অপর নাম ergocalciferol যা উদ্ভিদজাত উৎস হতে পাওয়া যায়।
  • ভিটামিন ডি-৩: এর অপর নাম cholecalciferol যা প্রাণিজ উৎস থেকে পাওয়া যায়।

এই দুই প্রকারের ভিটামিন ডি যদিও একই রকমের তথাপি এদের মাঝে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। উভয়ের ক্ষেত্রেই লিভার ও কিডনির ভিতর রাসায়নকি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় শরীরে সক্রিয়তা লাভের জন্য। কিন্তু এদের সক্রিয় করার কাজে  ভিন্ন ভিন্ন এনজাইমের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেহে ভিটামিন ডি-৩ এর ভূমিকা ডি-২ এর চেয়ে অধিক গুরত্বপূর্ণ।

ভিটামিন ডি এর উৎস

সূর্যের আলো এই ভিটামিনের ক্ষেত্রে খুব ভাল একটি উৎস। আলোর তীব্রতার উপর ভিত্তি করে আপনি দৈনিক ১৫ থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় সূর্যের আলো সরাসরি গায়ে লাগিয়ে এর চাহিদা মেটাতে পারেন। এমনভাবে আলোর সংস্পর্শে যেতে হবে যাতে সূর্যের আলো সরাসরি আপনার শরীরের চামড়ার উপর এসে পতিত হয়।

তবে, শীত প্রধান দেশে শীতের সময় সুর্যের আলোর সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ থাকেনা। তখন, খাদ্যের সাথে ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ করতে হবে।

এই ভিটামিনের কয়েকটি উৎসের নাম দেওয়া হল যা খাদ্যে পাওয়া যায়-

  • তৈলাক্ত মাছ এবং মাছ থেকে সংগৃহিত তৈল:
    • কড লিভার ওয়েল (cod liver oil) : প্রতি চা চামুচ কড লিভার ওয়েলে ৪৫০ IU (international unit) ভিটামিন ডি থাকে যা একজন মানুষের দৈনিক চাহিদার প্রায় ৭৫%।
    • হ্যারিং (herring)
    • Swordfish
  • মাশরুম: আপনি যদি মাছ অপছন্দ করেন অথবা যদি সবজি ভোজি হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি সুনির্দিষ্ট মাশরুম বেছে নিতে পারেন। কিছু কিছু মাশরুপ প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ডি ধারণ করে। যেমন-
    • Raw maitake মাশরুম: এখানে ভিটামিন ডি এর পরিমান প্রতি ৫০ গ্রামে ৫৬২ IU.
    • Dried shiitake মাশরুপ: প্রতি ৫০ গ্রামে ৭৭১ IU ভিটিামিন ডি থাকে।
  • যকৃত বা লিভার
  • ডিমের কুসুম: ইহা ভিটামিন ডি এর একটি ভাল উৎস বিশেষ করে ঐসব মুরগির ডিম যারা মুক্ত হয়ে বিচরণ করে। দু’টি ভাজা ডিমে ৮৮ IU ভিটামিন ডি থাকে যা দৈনিক চাহিদার ১৫%।
  • ফর্টিফায়িড ফুড: কিছু কিছু উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তাদের উৎপাদিত খাদ্য পণ্যে ভিটামিন যোগ করে বাজারজাত করে। আমরা ঐসব খাদ্যকে ভিটামিন বা অন্যান্য পুষ্টি বিশিষ্ট fortified food বলে থাকি। সচারাচর যেসব খাদ্যে অতিরিক্ত ভিটামিন যোগ করা হয় তার উদাহারণ হতে পারে-
    • গরুর দুধ;
    • কমলার রস
    • নাস্তায় ব্যবহৃত বিভিন্ন দানাদার খাদ্য

দৈনিক কতটুকু ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন

এই ভিটামিন মাইক্রোগ্রাম (mcg) বা ইন্টারনেশনাল ইউনিট (IU) হিসাবে পরিমাপ করা হয়। যেখানে ১ মাইক্রোগাম হল ৪০ ইন্টারনেশনাল ইউনিট এর সমান।

  • যেসব শিশুর বয়স ১ বছর বা তার কম: 400 IU (40 mcg)
  • বয়স ১ থেকে ১৮ পর্যন্ত হলে: 600 IU (15 mcg)
  • বয়স ১৯ থেকে ৭০ পর্যন্ত:  600 IU (15 mcg)
  • সত্তুর বছরের অধিক বয়স হলে: 800 (20 mcg)

ভিটামিন ডি এর কাজ

আমাদের দেহ সুস্থা রাখার জন্য ভিটামিন ডি এর কাজ খুব গুরত্বপূর্ণ। নিচে ভিটামিন ডি এর কাজ উল্লেখ করা হল-

  • ইহা শরীর অস্থিসমুহ মজবুত ও শক্তিশালী করে। ইহা পরিপাকতন্ত্রের ক্ষুদ্রান্ত থেকে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণে কাজ করে যা শরীরের হার গঠনে অপরিহার্য। এর মাধ্যমে অস্টিওপোরোসিস নামের একটি রোগ প্রতিরোধ করে। এই রোগে আক্রান্ত হলে শরীরের হার ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
  • শরীরের মাংসপেশি শক্তিশালি করতে কাজ করে।
  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যার ফলে ক্ষতির জীবানু সহজে আক্রমন করে রোগ তৈরির মত অবস্থা তৈরি করতে পারে না।
  • ইহা দাতের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে।
  • টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কাজ করে।
  • উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা আছে।
  • দৈহিক ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করে।
  • দেহের অবসাদগ্রস্থতা দুরীকরণে এর ভূমিকা রয়েছে।
  • কিছু সুনির্দিষ্ট ধরণের ক্যানসার প্রতিরোধে কাজ করে।

যেসব কারণে ভিটামিন ডি এর অভাব হয়

এর অভাব কিছু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও দেখা দিতে পারে, যেমন-

  • যাদের ত্বক মোটা;
  • বয়স বেশী হলে বা বৃদ্ধ মানুষের ক্ষেত্রে;
  • যাদের দৈহিক ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি;
  • যারা মাছ বা দুগ্ধজাত খাদ্য খেতে অভ্যস্ত নয়;
  • যারা নিয়মিত sunscreen ব্যবহার করে;
  • যারা বেশি সময় ঘরের ভিতর থাকে;

ভিটামিন ডি এর অভাবে যে সব সমস্য হয়

সুস্বাস্থ্য ধরে রাখতে ভিটামিন ডি এর অনেক গুরত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। অন্যান্য ভিটামিনের সাথে এর পার্থক্য হল, ইহা শুধু ভিটামিন হিসাবেই কাজ করেনা বরং ইহা হরমোন হিসাবেও ভূমিক রাখে। শরীরের প্রত্যেকটি কোষে এই ভিটামিন গ্রহনের জন্য রিসিপ্টর থাকে।

আপনার শরীরে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে কোলেস্টেরলের সহায়তায় ইহা তৈরি হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন খাদ্য থেকেও আপনি এটি গ্রহন করতে পারেন। যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।

আমাদের শরীরে দৈনিক এর চাহিদা হল ৪০০-৮০০ IU. বিশেষজ্ঞগণের মতে আরোও বেশী হলে ভাল। এর অভাবজনিত রোগ সারাবিশ্বেই দেখা যায়। গবেষণা থেকে জানা যায় বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি লোকের মাঝে এর অভাব রয়েছে। এমনকি, ২০১১ সালের এক গবেষণামতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪১.৬% প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে এর অভাব দেখা গিয়েছে।

ভিটামিন ডি এর অভাবজনিত লক্ষণসমুহ নিচে উল্লেখ করা হল-

  • ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে যাওয়া;
  • পরিশ্রান্ত বা ক্লান্ত অনুভব হওয়া;
  • শরীরের হারে ও পিঠে ব্যাথা;
  • অবসাদগ্রস্থতা;
  • শরীরের ক্ষতস্থান শুকাতে দেরি হওয়া;
  • শরীরের হার-হাড্ডি দুর্বল হয়ে যাওয়া;
  • চুল পরে যাওয়া;
  • মাংসপেশিতে ব্যাথা হওয়া;

Reference:

  1. Spritzler, F., 2021. 8 Signs and Symptoms of Vitamin D Deficiency. [online] Healthline. Available at: <https://www.healthline.com/nutrition/vitamin-d-deficiency-symptoms#TOC_TITLE_HDR_1> [Accessed 17 March 2021].