Last updated on May 9th, 2023 at 05:27 pm
কিডনি পরীক্ষা কিভাবে করে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। যেহেতু, কিডনির রোগের লক্ষণ প্রাথমিক অবস্থায় প্রকাশ পায় না এবং শেষ পর্যায়ে ধরা পড়লে করার তেমন কিছু থাকেনা, তাই বিষয়টি গুরত্বপূর্ণ।
আপনি কি জানেন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশেও প্রতি তিনজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মাঝে এক জন কিডনি রোগের ঝুঁকির ভিতর আছে? যে কেউ যে কোন সময় কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
আমাদের দু’টি কিডনি যা মেরুদন্ডের নিচের দিকে দু’পাশে রয়েছে। এবডোমেন বা পেট এর পিছন দিকে পাজরের নিচে এদের অবস্থান।
আমাদের সুস্থ সবল হয়ে বেচে থাকতে কিডনি গুরত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদান করে। দেহে শারীরবৃত্তিয় কাজের বাই-প্রোডাক্টস হিসাবে যে সব বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি হয়ে রক্তে মিশে যায়, ঐ দুষিত রক্ত কিডনিতে এসে পরিশুদ্ধ লাভ করে। কিডনি রক্তের সেই দুষিত পদার্থসহ অন্যান্য অনাকাংখিত জিনিস ফিল্টার করে রক্ত থেকে পৃথক করে। তারপর সেগুলো মুত্রনালীতে জমা হয়ে দেহ থেকে বের হয়ে যায়।
এছাড়া, দেহের ভিতর পানি ও খনিজ লবনের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে কিডনি কাজ করে। রক্তের লোহিত কণিকা, ভিটামিন-ডি এবং হরমোন যা রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে – ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরিতে কিডনি ভূমিকা পালন করে।
কাজেই, এই কিডনি যদি সঠিক ভাবে কাজ করতে না পারে তাহলে বেচে থাকা দুষ্কর হয়ে যায়। এজন্য সময় থাকতে মাঝে মাঝে কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিডনি রোগের লক্ষণ দেরিতে প্রকাশ পায়।
আপনি যদি লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান তাহলে ক্ষতি যা হওয়ার তা পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।
যাহোক, আলোচ্য পোষ্টে, কিডনি পরীক্ষা কিভাবে করে সে বিষয়ে এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে আলোকপাত করব।
Table of Contents
কিডনি পরীক্ষা কিভাবে করে?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিডনি রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ অপ্রকাশিত থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার কিডনি মারাত্মক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, ততক্ষণ এর বাহ্যিক লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। এজন্য, আপনার কিডনি কিভাবে কাজ করছে তা জানার একমাত্র উপায় হলো তা পরীক্ষা করা।
বিশেষ করে যদি আপনার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা এই রোগের কোন পারিবারিক ইতিহাস থাকে, তাহলে তো কোন কথাই নেই।
এক্ষেত্রে, কিডনি রোগের লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও স্ব-উদ্যোগে বিশেষ গুরত্ব সহকারে আপনাকে টেষ্ট করিয়ে নিতে হবে। কারণ রোগ ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এবারে চলুন, কিডনি রোগের পরীক্ষা কিভাবে করে তা নিয়ে আলোচনা করি।
- প্রথমত: চিকিৎসক আপনার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাস নিবে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আপনার ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে কিনা তা দেখে নিবে। অত:পর আপনি কিডনির উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে এমন কোন ঔষধ সেবন করেছেন কিনা – ইত্যাদি বিষয়ে আপনার নিকট থেকে তথ্য নেওয়া হবে।
- দ্বিতীয়ত: চিকিৎসক আপনার ফিজিক্যাল পরীক্ষা করাবেন। খুঁজে দেখার চেষ্টা করবেন আপনার অন্যান্য ভাইটাল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হার্ট, রক্ত প্রবাহ এবং স্নায়ুতন্ত্র ঠিক-ঠাক মত কাজ করছে কিনা।
- তৃতীয়ত: কিছু ল্যাব টেষ্ট যার মাধ্যমে বুঝা যাবে আপনার কিডনির কার্যকারিতা। এটি কি স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে নাকি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকলে তার পরিমান কতটুকু বা কোন পর্যায়ে ক্ষতি সাধন হয়েছে। এই বিষয়গুলো ল্যাব টেষ্টের মাধ্যমে জানা যাবে।
এখন কিডনি পরীক্ষা কিভাবে করে তার অংশ হিসাবে কি কি ল্যাব টেষ্ট করা হয় সে বিষয়ে কথা বলব।
কিডনি পরীক্ষার নাম কি?
সাধারণত: রক্ত এবং মুত্র পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনি টেষ্ট করা হয়। প্রথমে রক্ত দিয়ে কিডনি পরীক্ষার নাম আলোচনা করছি।
কিডনি রোগের রক্ত পরীক্ষা
কিডনির মুল কাজ হলো রক্তে উপস্থিত বর্জ্য পদার্থ ও অতিরিক্ত পানি ফিল্টার করে রক্তকে পরিশুদ্ধ রাখা। এজন্য, রক্ত পরীক্ষার দ্বারা প্রতিয়মান হয় কিডনি তার যথাযথ কাজটি সঠিকভাবে করতে পারছে কিনা। অর্থাৎ রক্তে অতিরিক্ত পরিমানের বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেল কিনা – সেটাই মুলত: পরীক্ষা করে দেখা উদ্দেশ্য।
রক্তের যে সব পরীক্ষার দ্বারা কিডনি রোগ সনাক্ত করা হয় তা নিচে উল্লেখ করছি-
সিরাম ক্রিয়েটিনিন টেষ্ট
এই টেষ্টের মাধ্যমে রক্তে ক্রিয়েটিনিন এর পরিমান নির্নয় করা হয়। কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় যেমন কাজ করা উচিত তা যদি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে রক্তে ক্রিয়েটিনিন এর মাত্রা বেড়ে যাবে।
তবে, মনে রাখতে হবে, মানব দেহের রক্তে ক্রিয়েটিনিন এর স্বাভাবিক পরিমান কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে কম বেশী হতে পারে-
- মানেুষের লিঙ্গ অর্থাৎ পুরুষ না মহিলা
- বয়স
- দেহে মাংসপেশী পরিমান কম না বেশী
সাধারণত: মহিলার বেলায় রক্তে ক্রিয়েটিনিন যদি ১.২ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এবং পুরুষের যদি ১.৪ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এর অধিক হয় তাহলে ধরে নেওয়া হয় তার কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে পারছেনা। যদি, আপনার সিরাম ক্রিয়েটিনিন লেভেল স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক ধরা পরে, তখন চিকিৎসক আপনাকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য টেষ্ট করার সুপারিশ করতে পারেন।
গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট নির্ণয়
এটিকে সংক্ষেপে জিএফআর বলা হয়। রক্তে মিশ্রিত দুষিত বর্জ্য ও অতিরিক্ত তরল কিডনি কতটা সফলতার সাথে পৃথক করতে পারছে তা পরিমাপের জন্যই এই টেষ্ট করা হয়।
জিএফআর এর সংখ্যা গননার বেলায় নিচের ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়-
- সিরাম ক্রিয়েটিনিন লেভেল
- বয়স
- লিঙ্গ, ইত্যাদি।
কিডনির অন্যান্য পরক্ষার মত এটির ক্ষেত্রেও উপরের বিষয় তিনটি উপর ভিত্তি করে জিএফআর এর সংখ্যা কম বেশী হতে পারে।
জিএফআর তত কম পাওয়া যাবে, কিডনি রোগের তীব্রতা যত বেশী হবে। এজন্য জিএফআর টেষ্ট রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কিডনি রোগ পাঁচটি পর্যায় বা স্টেজ -এ ভাগ করা হয়েছে। স্টেজগুলি নিম্নরুপ-
- স্টেজ-১: জিএফআর যখন ৯০ বা তারও বেশী হয়। এটিকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়।
- স্টেজ-২: জিএফআর ৬০-৮৯ হলে। এক্ষেত্রে কিডনির কার্যকারিতা অল্প পরিমানে কমে যায়।
- স্টেজ-৩: জিএফআর যখন ৩০-৫৯ এর মধ্যে হয়। এর দ্বারা ধরে নেওয়া হবে আপনার কিডনির ক্ষতির পরিমান মধ্যম পর্যায়ে। এই পর্যায়ে কিছুটা লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন হাত-পা ফুলে যাওয়া, দেহের কিডনি যেখানে অবস্থিত সেখানে মৃদু ব্যথা অনুভূত হওয়া, ইত্যাদি।
- স্টেজ-৪: জিএফআর ১৫-২৯ এর মধ্যে হলে। এর দ্বারা কিডনিতে ক্ষতির পরিমান বেশী বলে বিবেচিত হবে। তখন, রক্ত চাপ, রক্ত শূণ্যতাসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা প্রকাশ পাবে।
- স্টেজ-৫: জিএফআর যখা ১৫ এর চেয়ে কম পাওয়া যাবে। এই পর্যায়ে কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বলে ধরে নেওয়া হয়। যা কিডনি ফেইলিউর এর খুব নিকটবর্তি।
রক্তে ইউরিয়া নাইট্রোজেন পরীক্ষা:
এই টেষ্ট এর মাধ্যমে রক্তে ইউরিয়া নাইট্রোজেন এর পরিমান পরিমাপ করা হয়। ইউরিয়া নাইট্রোজেন দেহের জন্য এক প্রকারের বর্জ্য পদার্থ যা প্রোটিন ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে তৈরি রক্তে মিশ্রিত অবস্থায় বিচরণ করে। যে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য আমরা খাবারের সাথে খেয়ে থাকি।
সুস্থ ও স্বাভাবিক কিডনি সহজেই তাকে রক্ত থেকে ফিল্টার করে মুত্র নালীতে জমা করে। কিন্তু, কিডনির কার্যকারিতা কমে গেলে সেটি রক্ত থেকে পুরোপুরিভাবে পৃথক হতে না পারায় রক্তেই বিদ্যমান থেকে যায়। ফলে, এই পরীক্ষায় তা অধিক মাত্রায় রক্তে ধরা পরে যায়।
কিডনি রোগের মুত্র পরীক্ষা
কিডনি রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণের মধ্যে একটি হলো মুত্রে প্রোটিনের উপস্থিতি। যাকে প্রোটিনিউরিয়া বলা হয়। এর জন্য নিচের পরীক্ষাটি সচারাচর করতে দেখা যায়-
মুত্রে এলবুমিন ও ক্রিয়েটিনিন এর অনুপাত পরীক্ষা করা
এই পরীক্ষার দ্বারা মুত্রে এলবুমিনের পরিমান বের করা হয় যা পরে ক্রিয়েটিনিন এর পরিমানের সাথে তুলনা করে দেখা হয়। এই টেষ্ট এর মাধ্যমে দেখা হয় গত ২৪ ঘন্টায় কি পরিমান এলবুমিন প্রস্রাবে চলে এসেছে।
টেষ্টটির ফলাফল ৩০ বা তার অধিক হলে কিডনিতে কোন সমস্যা আছে বলে ধরে নেওয়া হবে।
কিডনি পরীক্ষা খরচ
কিডনি পরীক্ষার খরচ তেমন বেশী নয়। সরকারি হাসপাতালে নাম মাত্র খরচেই টেষ্ট করিয়ে নিতে পারবেন। তবে, প্রাইভেট ক্লিনিকে খরচ এক রকম নাও হতে পারে। ক্লিনিকের মান ভেদে খরচ এর পরিমান কম বেশী হতে পারে।
এখন, ইন্টারনেট মোবাইলের যুগে আপনার পছন্দের হাসপাতাল বা ক্লিনিকের যোগাযোগের ঠিকানা থেকে মোবাইলে যোগাযোগ করে কিডনি পরীক্ষার খরচ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেতে পারেন।
উপসংহার
কিডনি মানব দেহের একটি গুরত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের দেহের সার্বিক সুস্থতার জন্য কিডনির সুস্থতা অপরিহার্য। যেহেতু, কিডনির রোগের প্রাথমিক অবস্থায় এর লক্ষণ অপ্রকাশিত থাকে তাই নিজ উদ্যোগে আপনাকে স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে কিডনি পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
উপরন্তু, যদি আপনার বয়স চল্লিশোর্ধ হয়ে থাকে এবং একই সাথে আপনি যদি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগে থাকেন, তাহলে আর দেরী নয়। খুব দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে কিডনি টেষ্ট করিয়ে ফেলুন।
পরিশেষে, কিডনি রোগের পরীক্ষা কিভাবে করে – বিষয়টির উপর উপস্থাপিত তথ্যসমূহের কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানানোর অনুরোধ করছি।