ক্রিয়েটিনিন কি এবং এর আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে আজকের পোষ্ট। এমন অনেক স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি রয়েছেন যারা নিজ উদ্যোগে সময়ে সময়ে দেহ সার্বিকভাবে সুস্থ রয়েছে কিনা তার উপর রুটিন কিছু টেষ্ট করিয়ে থাকেন।

আর এই টেষ্টগুলোর মধ্যে ক্রিয়েটিনিনও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা পরীক্ষাটি আসলে কি এবং কেনই বা করা হয়।

তাই, আলোচ্য পোষ্টে ক্রিয়েটিনিন কি, এটি কেন বাড়ে, বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ কি, ক্রিয়েটিনিন কত হলে ডায়ালাইসিস করাতে হয় – ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কিছু তথ্য উপস্থাপনের চেষ্টা করব।

চলুন, শুরু করা যাক।

ক্রিয়েটিনিন কি?

ক্রিয়েটিনিন হলো রক্তে এক ধরণের বর্জ্য পদার্থ যা দেহের মাংসপেশীর দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসাবে তৈরি হয়ে রক্তে মিশে যায়।

স্বাভাবিকভাবে আপনার কিডনি সুস্থ থাকলে রক্ত থেকে ফিল্টার করে এটিকে পৃথক করে। তারপর মুত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে তা বের হয়ে যায়।

মানবদেহে দু’টি কিডনি থাকে। প্রতিটি কিডনি লক্ষ লক্ষ নেফ্রন দিয়ে গঠিত যাকে কিডনির ক্ষুদ্রতম একক বলা হয়। নেফ্রনের সাহায্যেই রক্ত ফিল্টার করার কাজটি অবিরামভাবে চলমান থাকে। নেফ্রনের ভিতর গুচ্ছাকারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে রক্তনালীসমূহ থাকে তাকে গ্লোমেরুলি বলা হয়। যা দিয়েই কিডনির ভিতর রক্ত ফিল্টারের কাজ সম্পন্ন হয়।

এই ফিল্টারিং প্রক্রিয়ায় রক্তে মিশ্রিত বিষাক্ত বর্জ্য, অতিরিক্ত তরল পদার্থ ও অন্যান্য দুষিত বস্তু রক্ত থেকে পৃথক হয়ে যায়।

এভাবে কিডনি দিয়ে অতিক্রমের মাধ্যমে রক্ত পরিশুদ্ধ লাভ করে এবং পুনরায় তা দেহের ভিতর প্রবাহমান হয়। আর ফিল্টারিং এর ফলে পৃথকিকৃত বর্জসমূহ মুত্র থলিতে জমা হয়ে মুত্রের সাথে দেহে থেকে অপসারণ হয়ে যায়।

রক্তে ক্রিয়েটিনিন লেভেল পরিমাপ করে চিকিৎসকগন বুঝতে পারে যে আপনার কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। অর্থাৎ কিডনির এই ফিল্টারিং কার্যক্রম যথাযথ ভাবে চলছে কিনা তা পরীক্ষা করা যায়।

রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী হয় তাহলে আপনার কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

ক্রিয়েটিনিন কেন বাড়ে?

আপনার কিডনিতে কোন সমস্যা দেখা দিলে কিডনি তখন তার স্বাভাবিক ফিল্টার করার কাজ সম্পাদানে ব্যর্থ হয়। তখন রক্ত কিডনি দিয়ে অতিবাহিত হওয়ার সময় ক্রিয়েটিনিন রক্ত থেকে আলাদা হতে পারে না। ফলে তা রক্তেই থেকে যায় এবং এর দ্বারা রক্তে ক্রিয়েটিনিন এর মাত্রা বেড়ে যায়।

রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা কত?

রক্তে ক্রিয়েটিনিন প্রতি ডেসিলিটারে কত মিলিগ্রাম থাকে সে হিসাবে পরিমাপ করা হয়। অর্থাৎ, মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার হিসাবে।

তবে, যারা মাসল ম্যান বা যাদের শরীরে মাংসপেশী অধিক থাকে তাদের ক্রিয়েটিনিন লেভেল বেশী থাকতে পারে। তাছাড়া, বয়স এবং লিঙ্গ ভেদে মানুষের রক্তে ক্রিয়েটিনিন লেভেল কম বেশী হতে পারে।

সাধারণ ভাবে, পুরুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ক্রিয়েটিনিন এর মাত্রা ০.৯ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার থেকে ১.৩ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

অপরদিকে, মহিলার বেলায় তা ০.৬ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার থেকে ১.১ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার পর্যন্ত হতে পারে।

তবে, উপরোক্ত লেভেল ঐ সব পুরুষ বা মহিলার বেলায় হবে যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬০ মধ্যে হবে। ষাটোর্ধ মানুষের ক্ষেত্রে এই মাত্রা কিছুটা বেশী হতে পারে।

রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ক্রিয়েটিনিন এর উপস্থিতি বলে দেয় যে কিডনি তার স্বাভাবিক কার্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। যা ঠিক মত কাজ করতে পারছে না।

তবে, নিচের রোগ সমূহের কারণে ক্রিয়েটিনিন এর পরিমান কিছুটা বেশী হতে পারে –

  • মুত্র নালীতে ব্লক থাকলে
  • উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে
  • পানিশূণ্যতা হলে
  • কিডনিতে ইনফেকশন থাকলে, ইত্যাদি।

আপনার রক্তে যদি অধিক পরিমানে ক্রিয়েটিনিন ধরা পড়ে তাহলে যে কারণে এটি হয়েছে তা সর্বপ্রথম চিহ্নিত করতে হবে। তারপর, সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিলে তা স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে আসতে পারে।

ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ কি কি?

ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসাবে নিচের উপস্বর্গগুলো বিবেচনায় নিতে পারেন-

  • ঘুমের সমস্যা হলে
  • ক্ষুধামন্দা সৃষ্টি হলে
  • মুখ মন্ডল, হাতের কব্জি, পা এবং পেটের চারপাশে ফুলে গেলে
  • কোমরের উপরে যেখানে কিডনি অবস্থান করে সেখানে ব্যথা অনুভুত হলে
  • ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হলে এবং প্রস্রাবের পরিমান পরিবর্তন হলে
  • চোখের নিচের অংশ ফুলে গেলে
  • বমি বমি ভাব মনে হলে
  • বমি হলে, ইত্যাদি।

উপরোক্ত লক্ষণ সমূহ ব্যাতিরেকে যদি আপনি নিচের রোগগুলোয় আক্রান্ত থাকেন তাহলে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। রোগগুলি নিম্নরুপ-

  • টাইপ-১ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস
  • উচ্চ রক্ত চাপ
  • কিডনি রোগের কোন পারিবারিক ইতিহাস থাকলে
  • বয়স ষাট বা তদোর্ধ হলে

ক্রিয়েটিনিন কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয়?

এটি আসলে সে ভাবে বলার সুযোগ নেই। আপনার চিকিৎসক আপনার সার্বিক অবস্থা বিচার করে ক্রিয়েটিনিন ছাড়াও আরোও বেশ কিছু পরীক্ষা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিবেন।

তবে, সাধারণত: দেখা যায়, যাদের কিডনি ফাংশন কমতে কমতে ১৫% বা তারও কমে গিয়ে দাড়ায়, তখন ডায়ালাইসিস করতে দেখা যায়। যা কিডনি ফাংশন হ্রাসের পাঁচটি ধাপের মধ্যে সর্ব শেষের ধাপ হিসাবে পরিগনিত।

বন্ধুগন, ক্রিয়েটিনিন কি এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে সব তথ্য তুলে ধরা হলো, তার উপর কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানানোর অনুরোধ করছি। সবাই সুস্থ থাকুন ও ভাল থাকুন।