Last updated on May 14th, 2023 at 05:46 am

আপনি কি কখনোও ভেবেছেন, আপনার জ্যাকেটের উলের অংশগুলো কেন এত মোলায়েম ও নরম মনে হয়? আপনি কি লক্ষ করেছেন যে, আপনার পরিধেয় প্যান্টের কাপড়টি কি করে পানি প্রতিরোধক হল? আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগে- বাজারে কাপড় কিনতে গেলে দোকানে সাজিয়ে রাখা কাপড়গুলি কেন এত আকর্ষণীয় লাগে?

কোন মার্কেটের পোশাকের দোকানে গেলে পোশাক কেনার আগে আপনি নিশ্চয়ই আপনার পছন্দের পোশাকের কিছু বৈশিষ্ট নিরুপন করে থাকেন যার উপর ভিত্তি করে আপনি পোশাকটি ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেন। যেমন- পোশাকটি দেখতে কেমন, নরম হবে কিনা, শীতের সময় গায়ে দিলে গরম অনুভব হবে কিনা ইত্যাদি।

তৈরি পোশাকে এই জাতীয় গুন যে পদ্ধতি অনুসরণের ফলে অর্জন হয় তা হল টেক্সটাইল ফিনিশিং। এই পোস্টের আলোচ্য বিষয় হল ফিনিশিংকাকে বলে, ফিনিশিং কত প্রকার, কিভাবে ফিনিশিং করা হয় ও কেন করা হয় – ইত্যাদি বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরা। চলুন – শুরু করি।

টেক্সটাইল ফিনিশিং কাকে বলে?

টেক্সটাইল ফিনিশিং হল এক প্রকার রাসায়নিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতি যা বস্ত্র শিল্প থেকে প্রস্তুকৃত ওভেন বা নিট কাপড় গ্রাহকের হাতে পৌঁছানোর পূর্বে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ফ্যাক্টরি থেকে তৈরিকৃত কাপড়কে গ্রাহকের নিকট ব্যবহার উপযোগী করে গোড়ে তোলার প্রক্রিয়াই হল টেক্সটাইল ফিনিশিং।

একটি লক্ষণিয় বিষয় হল-

টেক্সটাইল ফিনিশিং প্রক্রিয়ার ভিতর ডাইং অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং ডাইং কার্যক্রম যাতে ভালভাবে সম্পন্ন হতে পারে তার ক্ষেত্র তৈরিতে টেক্সটাইল ফিনিশিং ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ কাপড়কে ডাইং করার উপযোগী করে গোড়ে তোলে।

বস্ত্র শিল্পের সর্বপ্রথম উৎপাদিত পন্যের নাম হল গ্রে কাপড়। এরা তখন পর্যন্তও কাপড়ের প্রকৃতিগত রঙ ধারণ করে। ফ্যাক্টরি থেকে উৎপাদিত সর্বপ্রথম ধাপের পন্য হওয়ার কারণে গ্রে কাপড় কখনোও কখনোও অমসৃন বা খসখসে হতে পারে। এই কাপড়ে কিছুটা ময়লা লেগে থাকতে পারে। যার ফলে পরবর্তি প্রক্রিয়াজাত ব্যাতিরেকে গ্রে কাপড় ব্যবহার উপযোগী হয়না। মানে হল, ব্যবহারের জন্য গ্রে কাপড় দিয়ে কোন পোশাক বা অন্য কিছু তৈরি করা যায়না।

ফ্যাক্টরি থেকে উৎপাদিত গ্রে কাপড় ব্যবহার উপযোগী হিসাবে তৈরির জন্যই তখন ফিনিশিং প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। যার মাধ্যমে গ্রে কাপড়ের ঐ খসখসে বা অমসৃনতা দুর হয়ে যায়। কাপড়ের প্রকৃতিগত রঙ বা অন্যান্য লেগে থাকা ময়লা দুরীভূত হযে যায়।

মনে রাখার জন্য আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ফিনিশিং প্রক্রিয়াটি ডাইং এর আগে এবং পরে উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যেতে পারে। ডাইং এর পর অনেক সময় প্রিন্টিং করা হয়। পরিশেষে ফিনিশিং করে কাপড় বাজারে ছাড়া হয়।

সময়ের পথ পরিক্রমায় অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তি নির্ভর ফিনিশিং প্রক্রিয়া বের হয়েছে যার মাধ্যমে আপনার কাপড়কে আরোও আকর্ষণীয় বা দৃষ্টি নন্দন করে গোড়ে তুলতে পারেন। যেমন, উদাহারণ স্বরুপ বলা যেতে পারে steaming যা কাপড়ের কুচকানো অবস্থাকে দুর করে দেয়।

এবারে আলোচনা করব টেক্সটাইল ফিনিশিং কত প্রকার হতে পারে তা নিয়ে।

টেক্সটাইল ফিনিশিং কত প্রকার:

ফিনিশিং প্রক্রিয়ার ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে এটিকে মুলত: চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে-

  • Temporaty finish: এটি হল অস্থায়ি প্রক্রিয়ার ফিনিশিং যা শুধু প্রথমবার পানিতে ধৌত করার মাধ্যমেই এর কার্যকারিতা চলে যায়। কাপড়ে এই ধরণের ফিনিশিং সাধারনত বিভিন্ন প্রকার pasting সামগ্রি দিয়ে করা হয়। এই পেস্টিং ম্যাটেরিয়ালস আঠাল বা filling জাতীয় পদার্থ, কাপড় নরম ও চকচকে করতে সহায়তা করে এমন কোন পদার্থ, গ্লেইজিং এজেন্ট ইত্যাদি দিয়ে গঠিত।
  • Semi-durable finish: এই ধরণের ফিনিশিং temporary finishing এর চেয়ে অধিক স্থায়ি হয়। এর গড় স্থায়িত্বকাল নির্ভর করে কি ধরনের এজেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তার উপর। যেমন পানি প্রতিরোধক বা waterproof ফিনিশিং ব্যবহার করা যা বিশেষ ধরণের রাসায়নিক পদার্থ যেমন মোম দিয়ে করা হয়। এর ফলে কাপড়ের উপর একটি পাতলা আবরণ তৈরি হয় যা ভেদ করে পানি প্রবেশ করতে পারে না। এছাড়াও, রাবার, শুস্ক ধরণের তৈলাক্ত পদার্থ এই জাতীয় ফিনিশিং এর ক্ষেত্রে বেশী ব্যবহৃত হয়। তবে, ইদানিংকালে কিছু সিনথেটিক পদার্থের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন, butyl rubber, পলি ভিনাইল ক্লোরাইড, সিনথেটিক রেসিন ইত্যাদি। এই ফিনিশিং প্রক্রিয়ায় পানি নিবারণ ক্ষমতা নির্ভর করে কাপড়ে উপর আবরনের মাত্রা কতটুকু তার উপর।
  • Durable finish: এক্ষেত্রে কাপড় সাধারণত: এর আয়ুস্কাল পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। তবে, এর স্থায়িত্বকাল প্রতি বার ধৌত করার সময় কমে যেতে থাকে। কাপড়টি ব্যবহারের শেষ পর্যায়ে ফিনিশিং এর কোন প্রভাব বা ফলাফল অবশিষ্ট থাকেনা।
  • Permanent finish: এই ধরণের ফিনিশিং টেকসই হয়। বার বার ধৌত করা হলেও এটি তার গুনগত মান বা বৈশিষ্ট ধরে রাখতে পারে। এই ধরণের ফিনিশিং প্রক্রিয়া সাধারনত: কাপড়ের ফাইবারের উপর কাজ করে রাসায়নিকভাবে ফাইবারের গঠন শৈলীর পরিবর্তন সাধন করে। ফলে কাপড়ের আয়স্কাল পর্যন্ত একে টেকসইভাবে ব্যবহার করা যায়।

টেক্সটাইল ফিনিশিং কিভাবে করা হয়?

ফিনিশিং হল wet processing এর সর্বশেষ ধাপ। একটি টেক্সটাইল পণ্য যেখানে ডাই বা প্রিন্ট যেটাই করা হউক না কেন তারপর বাজারজাত করার পূর্বে এটিকে ফিনিশিং প্রক্রিয়ার ভিতর যেতে হয়। বিভিন্ন পদ্ধতির ফিনিশিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টেক্সটাইল পন্যটি গ্রাহকের নিকট আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক হিসাবে তৈরি করা হয়।

টেক্সটাইল ফিনিশিং সাধারনত: দুইভাবে করা হয়। একটি ফিজিক্যাল আর অপরটি হল কেমিক্যাল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফিনিশিং প্রক্রিয়া তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়, যেমন-

  • ধৌতকরণ বা washing
  • শুস্ককরণ drying
  • Pressing এবং Aesthetics

ধৌতকরণ হল ফিনিশিং প্রক্রিয়ার পরবর্তি ধাপে অংশগ্রহণের জন্য একটি প্রস্তুতিমুলক পর্ব যার মাধ্যমে কাপড় উৎপাদনের সময় কাপড়ে লেগে থাকা যেকোন রকমের ময়লা আবর্জনা ও দুষিত পদার্থ দুর করা হয়। এই ধৌতকরণ আবার কয়েকভাবে করা হয়, যেমন-

  • Bleaching: যা ফ্যাক্টরি থেকে উৎপাদিত গ্রে কাপড়ের প্রকৃতিগত রঙ দুর করে কাপড়কে সাদ রঙে রুপান্তরিত করে।
  • Carbonizing: প্রক্রিয়াজাতকৃত উল কাপড়ে কখনোও কখনোও vegetable এর উপস্থিতির কারণে অপরিস্কার থাকে। তখন সালফিউরিক এসিডের সাহায্যে এই অপরিচ্ছন্নতা দুর করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে carbonization বলে।
  • Desizing: টেক্সটাইল জগতের ভাষায় size সামগ্রীর প্রধান অংশ হল স্টার্চ, মোম বা চর্বি জাতীয় পদার্থ। Desizing হল এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে কাপড় বোনার পর উভেন কাপড়ের wrap yarn থেকে এই জাতীয় size পদার্থ অপসারণ করা হয়।
  • Scouring: কাপড় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাপড়ের মধ্যে জমাকৃত ময়লা, মোম বা অন্য কোন অনাকাংখিত পদার্থ অপসারণ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয়।

শুস্ককরণ বা drying: কাপড়ের গুনগত মান সবচেয়ে বেশী বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিক ফিনিশিং প্রক্রিয়া টেক্সটাইল ফিনিশিং এর এই প্রক্রিয়ায় যোগ করা হয়। এই রাসায়নিক ফিনিশিং যোগ বা বিয়োগ উভয় ধরণের হতে পারে। এডিটিভ ফিনিশিং এর মাধ্যমে কাপড়ে যোগ করা রাসায়নিক পদার্থ শোষিত হয়ে কাপড়ের ওজন বাড়িয়ে দেয়।

ফিনিশিং কেন করা হয়?

  • কাপড়ের রঙ, প্যাটার্ন অধিক আকর্ষণীয় ও দীপ্তিময় করে তৈরি করার জন্য।
  • কাপড়ের টেকসই বৃদ্ধির জন্য এর গঠনগত বৈশিষ্টে পরিবর্তন নিয়ে আসে।
  • কাপড় হাতে ধরার সময় অনুভুতি ভাল হয়- যেমন, নরম, সতেজ ও দৃঢ় মনে হয়।
  • কাপড় পরিধানে আরামদায়ক লাগে।
  • কাপড় সহজে ধৌত করা যায় ও তারাতারি শুকিয়ে যায়।
  • কাপড় ধোয়ার পর কুচকিয়ে যায়না বা কুচকে গেলেও এর মাত্রা কম হয়।
  • কাপড়ের aesthetic value বৃদ্ধি পায় যার ফলে দেখতে রুচিসম্মত মনে হয়।