ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ: চলুন জেনে নেই বিস্তারিত!

ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ নিয়ে শুরু করছি আজকের আর্টিকেল। আসলে বিষয়টি এমন এক স্পর্শকাতর জিনিস যে এটি বেড়ে গেলে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত দেহে তেমন কোন শারীরিক পরিবর্তন ঘটে না। ফলে লক্ষণ বুঝা যায় না।

এর জন্য করণিয় হচ্ছে আপনি নারি-পুরুষ ভেদে চল্লিশোর্ধ বয়সের মানুষ হলে নিয়মিত হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন।

এমন অনেক স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি রয়েছেন যারা নিজ উদ্যোগে সময়ে সময়ে দেহ সার্বিকভাবে সুস্থ রয়েছে কিনা তার উপর রুটিন কিছু টেষ্ট করিয়ে থাকেন। আর এই টেষ্টগুলোর মধ্যে ক্রিয়েটিনিনও অন্তর্ভুক্ত।

আলোচ্য পোষ্টে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ ও এর সাথে আনুসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে কথা বলব।

চলুন, শুরু করা যাক।

ক্রিয়েটিনিন কি?

ক্রিয়েটিনিন হলো রক্তে এক ধরণের বর্জ্য পদার্থ যা দেহের মাংসপেশীর দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসাবে তৈরি হয়ে রক্তে মিশে যায়।

স্বাভাবিকভাবে আপনার কিডনি সুস্থ থাকলে রক্ত থেকে ফিল্টার করে এটিকে পৃথক করে। তারপর মুত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে তা বের হয়ে যায়।

মানবদেহে দু’টি কিডনি থাকে। প্রতিটি কিডনি লক্ষ লক্ষ নেফ্রন দিয়ে গঠিত যাকে কিডনির ক্ষুদ্রতম একক বলা হয়। নেফ্রনের সাহায্যেই রক্ত ফিল্টার করার কাজটি অবিরামভাবে চলমান থাকে। নেফ্রনের ভিতর গুচ্ছাকারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে রক্তনালীসমূহ থাকে তাকে গ্লোমেরুলি বলা হয়। যা দিয়েই কিডনির ভিতর রক্ত ফিল্টারের কাজ সম্পন্ন হয়।

এই ফিল্টারিং প্রক্রিয়ায় রক্তে মিশ্রিত বিষাক্ত বর্জ্য, অতিরিক্ত তরল পদার্থ ও অন্যান্য দুষিত বস্তু রক্ত থেকে পৃথক হয়ে যায়।

আরো দেখুন- ক্রিয়েটিনিন কত হলে ডায়ালাইসিস করাতে হয়।

এভাবে কিডনি দিয়ে অতিক্রমের মাধ্যমে রক্ত পরিশুদ্ধ লাভ করে এবং পুনরায় তা দেহের ভিতর প্রবাহমান হয়। আর ফিল্টারিং এর ফলে পৃথকিকৃত বর্জসমূহ মুত্র থলিতে জমা হয়ে মুত্রের সাথে দেহে থেকে অপসারণ হয়ে যায়।

রক্তে ক্রিয়েটিনিন লেভেল পরিমাপ করে চিকিৎসকগন বুঝতে পারে যে আপনার কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। অর্থাৎ কিডনির এই ফিল্টারিং কার্যক্রম যথাযথ ভাবে চলছে কিনা তা পরীক্ষা করা যায়।

রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী হয় তাহলে আপনার কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

ক্রিয়েটিনিন কেন বাড়ে?

আপনার কিডনিতে কোন সমস্যা দেখা দিলে কিডনি তখন তার স্বাভাবিক ফিল্টার করার কাজ সম্পাদানে ব্যর্থ হয়। তখন রক্ত কিডনি দিয়ে অতিবাহিত হওয়ার সময় ক্রিয়েটিনিন রক্ত থেকে আলাদা হতে পারে না। ফলে তা রক্তেই থেকে যায় এবং এর দ্বারা রক্তে ক্রিয়েটিনিন এর মাত্রা বেড়ে যায়।

রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা কত?

রক্তে ক্রিয়েটিনিন প্রতি ডেসিলিটারে কত মিলিগ্রাম থাকে সে হিসাবে পরিমাপ করা হয়। অর্থাৎ, মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার হিসাবে।

তবে, যারা মাসল ম্যান বা যাদের শরীরে মাংসপেশী অধিক থাকে তাদের ক্রিয়েটিনিন লেভেল বেশী থাকতে পারে। তাছাড়া, বয়স এবং লিঙ্গ ভেদে মানুষের রক্তে ক্রিয়েটিনিন লেভেল কম বেশী হতে পারে।

সাধারণ ভাবে, পুরুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ক্রিয়েটিনিন এর মাত্রা ০.৯ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার থেকে ১.৩ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

অপরদিকে, মহিলার বেলায় তা ০.৬ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার থেকে ১.১ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার পর্যন্ত হতে পারে।

তবে, উপরোক্ত লেভেল ঐ সব পুরুষ বা মহিলার বেলায় হবে যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬০ মধ্যে হবে। ষাটোর্ধ মানুষের ক্ষেত্রে এই মাত্রা কিছুটা বেশী হতে পারে।

রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ক্রিয়েটিনিন এর উপস্থিতি বলে দেয় যে কিডনি তার স্বাভাবিক কার্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। যা ঠিক মত কাজ করতে পারছে না।

তবে, নিচের রোগ সমূহের কারণে ক্রিয়েটিনিন এর পরিমান কিছুটা বেশী হতে পারে –

  • মুত্র নালীতে ব্লক থাকলে
  • উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে
  • পানিশূণ্যতা হলে
  • কিডনিতে ইনফেকশন থাকলে, ইত্যাদি।

আপনার রক্তে যদি অধিক পরিমানে ক্রিয়েটিনিন ধরা পড়ে তাহলে যে কারণে এটি হয়েছে তা সর্বপ্রথম চিহ্নিত করতে হবে। তারপর, সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিলে তা স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে আসতে পারে।

ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ কি কি?

আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, ক্রিয়েটিনিন হল এক ধরনের বর্জ্য পদার্থ। যা পেশির কার্যক্রমের ফলে উৎপন্ন হয়। কিডনি এটি ফিল্টার করে মূত্রের মাধ্যমে বের করে দেয়। তবে, কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেলে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।

এবারে, জেনে নেওয়া যাক রক্তে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ ও উপসর্গ।

১. অত্যাধিক ক্লান্তি দুর্বলতা : শরীরে অতিরিক্ত বর্জ্য জমে গেলে দুর্বলতা ও অবসাদ দেখা দিতে পারে।

. মূত্রের পরিমাণ রঙের পরিবর্তন

প্রস্রাব কমে যাওয়া বা ঘন হয়ে যাওয়া

মূত্রের রঙ গাঢ় হয়ে যাওয়া বা ফেনা যুক্ত হওয়া

৩. শরীরে ফোলাভাব (Edema):

বিশেষ করে মুখ, হাত ও পায়ে ফোলাভাব দেখা যেতে পারে।

৪. পিঠ বা কোমরে ব্যথা: কিডনির সমস্যা থাকলে কোমর বা পিঠের নিচের অংশে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

৫. বমিভাব ক্ষুধামন্দা : শরীরে টক্সিন জমে গেলে বমি ভাব, খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া এবং গ্যাসট্রিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

৬. উচ্চ রক্তচাপ : কিডনির কার্যকারিতা কমে গেলে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

৭. ত্বকের শুষ্কতা চুলকানি: রক্তে বর্জ্য পদার্থ জমে গেলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং চুলকানি দেখা দিতে পারে।

এছাড়া, ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসাবে নিচের উপস্বর্গগুলো বিবেচনায় নিতে পারেন-

  • ঘুমের সমস্যা হলে
  • ক্ষুধামন্দা সৃষ্টি হলে
  • মুখ মন্ডল, হাতের কব্জি, পা এবং পেটের চারপাশে ফুলে গেলে
  • কোমরের উপরে যেখানে কিডনি অবস্থান করে সেখানে ব্যথা অনুভুত হলে
  • ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হলে এবং প্রস্রাবের পরিমান পরিবর্তন হলে
  • চোখের নিচের অংশ ফুলে গেলে
  • বমি বমি ভাব মনে হলে
  • বমি হলে, ইত্যাদি।

যাহোক, ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও ধারণা পেলাম। রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া কিডনি সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হতে পারে। তাই উপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা মেনে চললে কিডনি ভালো রাখা সম্ভব।

উপরোক্ত লক্ষণ সমূহ ব্যাতিরেকে যদি আপনি নিচের রোগগুলোয় আক্রান্ত থাকেন তাহলে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। রোগগুলি নিম্নরুপ-

  • টাইপ-১ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস
  • উচ্চ রক্ত চাপ
  • কিডনি রোগের কোন পারিবারিক ইতিহাস থাকলে
  • বয়স ষাট বা তদোর্ধ হলে

ক্রিয়েটিনিন কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয়?

এটি আসলে সে ভাবে বলার সুযোগ নেই। আপনার চিকিৎসক আপনার সার্বিক অবস্থা বিচার করে ক্রিয়েটিনিন ছাড়াও আরোও বেশ কিছু পরীক্ষা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিবেন।

তবে, সাধারণত: দেখা যায়, যাদের কিডনি ফাংশন কমতে কমতে ১৫% বা তারও কমে গিয়ে দাড়ায়, তখন ডায়ালাইসিস করতে দেখা যায়। যা কিডনি ফাংশন হ্রাসের পাঁচটি ধাপের মধ্যে সর্ব শেষের ধাপ হিসাবে পরিগনিত।

বন্ধুগন, ক্রিয়েটিনিন কি এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে সব তথ্য তুলে ধরা হলো, তার উপর কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানানোর অনুরোধ করছি। সবাই সুস্থ থাকুন ও ভাল থাকুন।