কটন কাপড় কি – বিষয়টির উপর বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই – এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আপনিও নিশ্চয়ই এটি ব্যবহার করে থাকবেন। কেননা, কটন কাপড় বাজারে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আরামদায়ক একটি কাপড়। এর জন্য এটি সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

তবে, এতদসত্ত্বেও, আমাদের অনেকের নিকটই কাপড়টি সম্পর্কে বেসিক ধারণার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এর ফলে, কাপড় কিনতে গিয়ে মাঝে মাঝে ঠকতেও হয়। বিক্রেতা, কটনের সাথে মিক্সড ফেব্রিকস দিয়ে দিলে উপস্থিত সময়ে টের পেতে কঠিন হয়।

এজন্য, আলোচ্য পোষ্টে, কটন কাপড় কি, কটন কাপড় কত প্রকার, কটন কাপড়ের বৈশিষ্ট কেমন ইত্যাদি বিষয়ের উপর কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলব।

এছাড়া, এই কাপড়ের মধ্যে উন্নত মানের যেমন এসি কটন এবং স্লাব কটন সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।

তো, চলুন – চলে যাই মুল প্রসঙ্গে।

কটন কাপড় কি, কটন কাপড় কত প্রকার এবং আরোও কিছু বিষয়

কটন কাপড় কি?

কটন ফেব্রিক এর প্রচলিত নাম সুঁতি কাপড়। ইহা এক প্রকার প্রাকৃতিক কাপড় যা উদ্ভিদজাত উৎস তুলা গাছ থেকে উৎপাদন করা হয়। বিশ্বব্যাপী রয়েছে এর নানা বৈচিত্র। সারা পৃথিবীতে এর ব্যাবহারের এত ব্যাপকত যে মানুষের ধারণ বহু প্রাচিন কাল থেকে এর প্রচলন শুরু হয়েছে। ইতিহাসগণের মতে এর উৎপত্তি ভারত বর্ষ থেকে যার সময় আনুমানিক ৩২৫০-২৭৫০ খ্রি: পূর্ব।

তবে, কোন কোন প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে এটি মিশর থেকে প্রথম উৎপত্তি হয়েছে বলে দাবী করা হয়। ১৭৭০ সালে যুক্তরাজ্যের শিল্প বিপ্লব শুরুর আগ পর্যন্ত সীমিত পরিসরে এর ব্যবহার হত। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই মুলত এর ব্যবহারের আধিক্য তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

যার ফলে, বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশী ববহৃত এক ধরনের কাপড়। তুলা বৃক্ষের বীজের চারপাশে বিদ্যমান তুলার আঁশকে স্পিনিং এবং উইভিং প্রক্রয়ায় তৈরি হয় এই ফেব্রিক। টেক্সটাইলের ভাষায় আঁশকে ফাইবার বলা হয়।এই ধরণের কাপড় রাসায়নিকভাবে জৈব প্রকৃতির হয়। কারণ এখানে কোন কৃত্রিম উপাদান থাকে না। খৃস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে কটন কাপড় এর প্রচলন লক্ষ করা যায়।

কটন সাধারনত: বৃক্ষ পৃথিবীর গৃষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ভাল উৎপাদন হয়। কটন বৃক্ষ Malvaceae পরিবারভুক্ত  Gossypium জেনাসের আওতায় এক ধরণের গাছ যার তিনটি প্রজাতি বিশ্বব্যাপি তুলা উৎপাদনে চাষ করা হয়। প্রজাতি তিনটির মধ্যে Gossypium Hirsutum প্রজতিই হল বাণিজ্যিকভাবে তুলা উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বেশী পরিমানে চাষ করা হয়।

তুলার আঁশের সবচেয়ে সুবিধাজনক বিষয়টি হল এটিকে খুব সহজে সুক্ষভাবে স্পিন করা সত্ত্বেও এর ইয়ার্ণ শক্তিশালী থাকে।

 কটন কাপড় কিভাবে তৈরি হয়?

কটন কাপড় নিম্নোক্ত ধাপ অনুসরণ করে তৈরি করা হয়:

  • তুলা গাছ থেকে তুলা বীজ এবং এর চারপাশে মোলায়েমভাবে ফুলে থাকা তুলার আশকে একত্রে কটন সীড পড বা বল বলা হয়। এই কটন সীড পডকে সর্বপ্রথম তুলা বৃক্ষ হতে আলাদা করা। এর জন্য বিশেষ ধরণের মেশিন ব্যবহার করা হয়।
  • কটন সীড পড খুব ভালভাবে পরিস্কারের পর এর থেকে তুলার আঁশ পৃথক করা হয়। এর জন্য কটন Gin নামক এক প্রকারের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
  • মেশিনের সাহায্যে আলাদা হওয়া এই ফাইবারকে Lint বলা হয়। যা পরবর্তিতে ফাইবারের মান, দৈর্ঘ, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি বিবেচনায় শ্রেণীবিভাগা করা হয়। এরা Bale নামে সংরক্ষণ করা হয়।
  • এই Bale গুলি টেক্সটাইল মিলে বয়ন বা উইভিং এর জন্য বিক্রি করা হয়। সেখানে প্রথমে এই Lint গুলিকে Carding মেশিনের মাধ্যমে পরিস্কার করা হয়। Carding মেশিনে প্রক্রিয়াজাত হওয়ার পর Lint তখন নরম এবং প্যাচানোহীন দড়ির মত অবস্থায় পরিণত হয়ে যাকে Silver বলা হয়।
  • এই Silver তারপর স্পিনিং ফ্রেমে বসিয়ে Yarn তৈরি করা হয়।
  • এই Yarn থেকেই পরি উইভিং অথবা নিটিং মেশিনের মাধ্যমে ফেব্রিক তৈরি করা হয়। কটন ফাইবার থেকে নন ওভেন ফেব্রিকও তৈরি করা যায়।
  • এভাবে যে কাপড় পাওয়া গেল তাকে গ্রে কাপড় বলা হয়।
  • পরিশেষে এই গ্রে কাপড় ভালভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার পর ডাইং এবং প্রিন্টিং প্রক্রিয়া সম্পাদনের পর বাজারে ফিনিশড কাপড় হিসাবে ছাড়ার উপযোগী হয়।

কটন কাপড় কেমন বা বৈশিষ্ট কি?

কাপড় চেনার উপায় বুঝতে হলে আপনাকে এর বৈশিষ্টের উপর ধারণা থাকতে হবে। কটন কাপড় কেমন হয়ে থাকে তার কিছু বৈশিষ্ট নিচে উল্লেখ করছি।

  • এটি পরিধানে আরামদায়ক হবে।
  • নরম বা সফ্ট প্রকৃতির হয়।
  • ইহা আদ্রতা শোষন করতে পারে।
  • ভালভাবে প্রিন্ট করা যায় এবং প্রিন্টের রঙ ধরে রাখার ক্ষমতা আছে।
  • নরম হলেও এটি শক্ত বা টেকসই হয়।
  • সহজে ব্যবহার ও সেলাই করা যায়।
  • ধীরে ধীরে শুকিয়ে থাকে।
  • ধৌত করার সময় বা পানির সংস্পর্শে এলে সংকুচিত হয়।

কটন কাপড় কত প্রকার?

  • Muslin : প্লেইন উইভ কটন ফেব্রিক যা খুব নরম ও হালকা ওজনের হয়ে থাকে। এদের বয়ন তেমন একটা ঘন হয় না। Chenille :
  • Denim : এরা খুব শক্ত, ভারি এবং রোবাস্ট প্রকৃতির হয়। Twill Weave প্রক্রিয়া ব্যবহার করে এই ধরনের ঘন ওভেন কাপড় তৈরি করা হয়। ডেনিম কাপড় দিয়ে ক্যাজুয়াল পোশাক যেমন জিনস, স্কার্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
  • Chambray : হালকা থেকে মাঝারি ওজনের ওভেন ফেব্রিক যা কটন দিয়ে তৈরি। এদের দৈর্ঘ এবং প্রস্থ বরাবর সুতার মধ্যে বিভিন্ন রকম রঙের বৈচিত্র থাকে। সাধারনত: নীল, ধুসর অথবা কাল বর্ণের হয়ে থাকে। এসব কাপড় সেলাই করা সহজ এবং পরিধানে আরামদায়ক হয়। শার্ট, টপস এবং বাচ্চাদের পোশাক তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।
  • Chintz : এই কটন ফেব্রিক খুব ঘনভাবে বয়ন করা হয়। শক্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে যা দিয়ে গৃহ সজ্জার কাজে ব্যবহার করা হয়। এই ধরণের সুতি কাপড় সাধারনত: প্রিন্টের হয়।
  • Lawn : খুব হালকা প্রকৃতির এবং সুক্ষ ও মসৃণ ধরনের ওভেন ফেব্রিক। এই কাপড় পরিধানে আরামদায়ক হয়। মহিলাদের ব্লাউজ, সেলোয়ার-কামিজ ও বাচ্চাদের পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
  • Jersy Knit : কটন জার্সি টানলে প্রসারিত হয় এমন ধরনের কাপড় যা দিয়ে টি শার্ট তৈরি করা হয়।
  • Flannel : মাঝারি ওজন বিশিষ্ট প্লেইন অথবা টুইল উইভিং প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া এক ধরনের কটন কাপড়। এরা খুব নরম প্রকৃতির কাপড় হয়ে থাকে যা দিয়ে মহিলা ও বাচ্চাদের পোশাক তৈরি করা হয়।
  • Pima or Egyptian Cotton : এরা চমৎকার মান সম্পন্ন সুতি কাপড়।
  • Twill : একটি টেকসই ধরণের সুতি কাপড় যেখানে তির্যকভাবে রেখা অংকিত থাকে। এই কাপড় দিয়ে ট্রাওজার, স্কার্ট ইত্যাদি জাতীয় পোশাক তৈরি করা হয়।
  • Sateen : মাঝারি ওজনবিশিষ্ট এক ধরণের ওভেন ফেব্রিক। যা নরম, মসৃন এবং দীপ্তময় থাকে। প্রধানত: পোশাক তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।
  • Corduroy : মাঝারি থেকে ভারি ওজন বিশিষ্ট হয়। এই কাপড় ট্রাওজার জাতিয় পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
  • Velvet : মাঝারি ওজন সম্পন্ন ওভেন ফেব্রিক। এই কাপড় একটু দামী হয় এবং রাত্রিকালীন পোশাকের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
  • Terrycloth : এই ধরনের সুতি কাপড়ের আদ্রতা শোষণ করার অসাধারন বৈশিষ্ট থাকে। টাওয়েল তৈরিতে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয়।
  • Canvas : মাঝারি থেকে ভারি ওজন সম্পন্ন সুতি কাপড় যা প্লেইন উইভিং এর মাধ্যমে তৈরি করা হয়। যা অত্যান্ত শক্ত, দৃঢ় এবং টেকসই হয়ে থাকে। প্রথাগতভাবে এই কাপড় দিয়ে নৌকার পাল তৈরি হত। এছাড় ব্যাগ তৈরির কাজেও ক্যানভাস জাতিয় কাপড় ব্যবহৃত হয়।
  • Chino : এই কাপড়কে Drill কাপড়ও বল হয়। এর শক্ত এবং টেকসই প্রকৃতির হয়। টুইল উইভিং প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়।
  • Gabardine : টেকসই ওভেন ফেব্রিক এবং বৃষ্টির সময় পরিধান করা যায়।
  • Batiste : নরম প্রকৃতির এক ধরণে প্লেইন ওভেন ফেব্রিক।
  • Poplin : পপলিনকে কটন ব্রডক্লোথও বলা হয়। মাঝারি ওজন বিশিষ্ট শক্ত ও ঘন বয়ন করা কাপড়। এই কাপড় সেলাই করা সহজ। পপলিন কাপড় বহুমুখী কাজে ব্যবহৃত হয়। এদের অনেক রকমের প্রিন্ট থাকে। মহিলা ও বাচ্চাদের পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
  • Bedford Cotton
  • Voile : খুবই হালকা ওজনের সরল বয়ন করা সুতি কাপড় যার ভিতর দিয়ে আংশিকভাবে দেখা যায়। এরা প্রিন্টেরও হতে পারে। এই কাপড় দিয়ে মহিলা ও বাচ্চাদের কাপড় তৈরি করা হয়।
  • Cambric : ইহা সরল ওভেন সুতি কাপড় যা খুব সুক্ষ প্রকৃতির হয়। এই ধরণের সুতি কাপড় দিয়ে সাধারনত: মহিলা ও বাচ্চাদের পোশাক তৈরি করা হয়।

আরো দেখুন- কাপড় কত প্রকার ও কি কি?

এসি কটন কাপড় কি বা কাকে বলে?

এটি কটন কাপড়ের মধ্যে সবচেয়ে আরামদায়ক বলা চলে। সাধারণত: গরমের সময় মহিলাদের নিকট এটি খুব পছন্দের। বিশেষ তাদের থ্রি- পিস পোশাকে এসি কটন কাপড় এর ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়।

স্লাব কটন কাকে বলে?

স্লাব কটন এক ধরণের কটন কাপড়। এটিও বেশ পরিচিত এক ধরণের কাপড়।

বন্ধুগন, কটন কাপড় কি ও কটন কাপড় কত প্রকার – বিষয়ের উপর উপস্থাপিত তথ্যগুলোর কেমন লাগল? কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।

ভাল থাকুন!