Last updated on May 9th, 2023 at 01:14 pm
চিনা বাদাম আমাদের দেশে খুব পরিচিত একটি বাদামের নাম। এর ইংরেজি নাম হল peanuts. অনেক জায়গায় এই বাদামকে groundnuts, earthnuts এবং goober নামে ডাকা হয়।.
এটি এক প্রকার লিগিউম জাতীয় ফসল যা দক্ষিণ অ্যামেরিকা থেকে উৎপত্তি লাভ করে। এই প্রকার উদ্ভিদ এজন্যই চাষ করা হয় যাতে এর বীজকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। চিনাবাদাম উদ্ভিদ জগতের Fabaceae পরিবারভুক্ত। এই পরিবারের সব উদ্ভদই লিগিউমিনাস নামে পরিচিত।
তাই এটি beans, lentils ও soy জাতীয় পণ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
যদিও কাঁচা চিনাবাদামের পুষ্টিগুন ভাল তবুও এটি খুব কমই খাওয়া হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ভেজে খাওয়া হয়। অবসরের খাবার হিসাবে এটি মানুষের নিকট খুবই জনপ্রিয়।
এর বৈজ্ঞানিক নাম: Arachis hypogaea
এর আগের একটি পোষ্টে বিভিন্ন প্রকার বাদাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই আর্টিকেলে চিনাবাদামের পুষ্টগুন, চিনাবাদামের উপকারিতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এর ভূমিকা, চিনাবাদাম খাওয়ার নিয়ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।
চলুন, শুরু করি।
Table of Contents
চিনাবাদাম কোথায় বেশী পাওয়া যায়?
সাধারণত: গ্রীষ্ম প্রধান দেশে এই জাতীয় উদ্ভিদ অধিক পরিমানে জন্মায়। ২০১৬ সালে চিনাবাদামের বার্ষিক উৎপাদন হয়েছিল ৪৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন যার ৩৮% উৎপাদন হয় চিনে।
সর্বপ্রথম দক্ষিণ অ্যামেরিকায় চিনাবাদাম চাষ শুরু হয়। এর পর উত্তর অ্যামেরিকা, চায়না এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশ পর্যন্ত এর উৎপাদন বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে, সারা বিশ্বেই এটি খুব পরিচিত এবং জনপ্রিয় একটি উদ্ভিদজাত খাদ্য পন্যের নাম।
২০১৮ সালে সারা বিশ্বে চিনাবাদাম উৎপাদনের চিত্র লক্ষ করলে দেখা যায়, সারা বিশ্বের সর্বমোট উৎপাদনের ৪১% উৎপাদন হয় চায়নায়, এরপর ভারতে ১৪%, অ্যামেরিকায় ৭%, নাইজেরিয়া ৭% এবং অবশিষ্ট দেশগুলিতে ৩১% উৎপাদন হয়।
এই তথ্য মতে বিশ্বের মোট উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশী চিনাবাদাম উৎপাদিত হয় এশিয়ার দু’টি দেশ চিন এবং ভারতে।
চিনাবাদামের পুষ্টিগুন কেমন?
এক নজরে চিনাবাদামের পুষ্টিগুন প্রতি ১০০ গ্রামে:
১.ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টস বা বড় আকারের পুষ্টি উপাদান:
- প্রোটিন- ২৫.৮ গ্রাম;
- কার্বোহাইড্রেটবাশর্করা- ১৬.১৩ গ্রাম
- ফাইবারবাআঁশ- ৮.৫ গ্রাম
- সুগার- ৪.৭২ গ্রাম
২. ফ্যাটবাচর্বি:
- মনো আনসেচুরেটেড ফ্যাটস- ২৪.৪৩ গ্রাম
- পলি আনসেচুরেটেড ফ্যাটস- ১৫.৫৬গ্রাম
- সেচুরেটেড ফ্যাটস- ৬.২৮গ্রাম
৩. মিনারেলস বা খনিজ লবন:
- পটাসিয়াম- ৭০৫ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস- ৩৭৬ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম- ১৬৮ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম- ৯২ মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম- ১৮ মিলিগ্রাম
- আয়রন- ৪.৫৮ মিলিগ্রাম
- জিংক- ৩.২৭ মিলিগ্রাম
৪. ভিটামিনস বা খাদ্যপ্রান-
- ভিটামিন বি-৩ বানিয়াসিন- ১২.০৭ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন ই বাআলফাটকোফেরল- ৮.৩৩মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি-১ বাথায়ামিন- ০.৬৪মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি-৬ বাপাইরিডক্সিন- ০.৩৫মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি-১২ বারিবোফ্ল্যাবিন- ০.১৪মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি-৯ বাফলেট- ২৪০ মাইক্রোগ্রাম
চিনাবাদামে উপস্থিত প্রধান প্রধান খাদ্য উপাদানের আরোও কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য:
১. আমিষ বা প্রোটিন:
আপনি জেনে থাকতে পারেন, প্রাণিজাত আমিষের তুলনায় উদ্ভিদজাত আমিষ অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। কেননা, উদ্ভিদজাত আমিষে কোলেস্টেরল থাকেনা। আর চিনাবাদাম হল উদ্ভিদজাত আমিষের চমৎকার একটি উৎস। এখান থেকে প্রতি ১০০ গ্রামে আপনি ২৫.৮ গ্রাম প্রোটিন পেতে পারেন যা কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রোটিন চাহিদার প্রায় অর্ধেক যোগান দেয়।
যেমনভাবে, শর্করা জাতীয় খাদ্যের ক্ষুদ্রতম একক গ্লুকোজ, একইভাবে আমিষ জাতীয় খাদ্যের ক্ষুদ্রতর একক হল এমাইনো এসিড। এমাইনো এসিডের মোট সংখ্যা ২০ টি। আর এই বাদামে ২০ প্রকার এমাইনো এসিডের প্রত্যেকটি উপস্থিত থাকে। শুধু তাই নয়, আরজিনিন এর মত প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড যা আমাদের দেহের রক্তনালীকে সচল এবং কর্মক্ষম রাখতে সহায়তা করে, তা পরিমানে অধিক থাকে।
বিশেষজ্ঞ কর্তৃক নির্ধারিত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রোটিন চাহিদার পরিমান –
- মহিলার ক্ষেত্রে- ৪৬ গ্রাম;
- পুরুষের ক্ষেত্রে- ৫৬ গ্রাম;
এছাড়াও, দৈনিক প্রোটিন গ্রহনের মাত্রা কোন মানুষের বয়স এবং তার দৈহিক পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে কমবেশি হতে পারে। প্রোটিন এমন একটি অত্যাবশ্যকিয় খাদ্য উপাদান যা মানবদেহের কোষগঠন এবং দেহের ক্ষয়পূরণে কাজ করে থাকে।
২. ফ্যাট বা চর্বি:
সুষম খাদ্যের প্রয়োজনীয় একটি অংশ হল ফ্যাটি এসিড। আবার ফ্যাটি এসিড সাধারনত: দু’ প্রকারের হয়। একটি সম্পৃক্ত বা স্যাচুরেটেড আর অপরটি হল অসম্পৃক্ত বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড। স্বাস্থগত বিচারে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিডকে উপকারি হিসাবে গন্য করা হয়।
মজার বিষয় হল, চিনাবাদামের অধিকাংশ ফ্যাটই মনো আনস্যাচুরেটেড এবং পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড দিয়ে তৈরি।
অ্যামেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন (AHA) এর মতে, স্যাচুরেটেড বা সম্পৃক্ত ও ট্র্যানস ফ্যাটের পরিবর্তে অসম্পৃক্ত যেমন মনো আনস্যাচুরেটেড এবং পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড খাওয়ার দ্বারা মানুষের রক্তের কোলেস্টেরল লেভেল উন্নতি হয়। যা পরবর্তিতে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
এই বাদামে সামান্য পরিমানে সম্পৃক্ত ফ্যাটের উপস্থিতিও বিদ্যমান থাকে। সম্পৃক্ত ফ্যাট অসম্পৃক্ত ফ্যাটের তুলনায় কম স্বাস্থ্যকর। চিকিৎসকগন হৃদরোগের কারণ হিসাবে অধিক মাত্রায় সম্পৃক্ত ফ্যাটকে চিহ্নিত করেছেন।
এজন্য অধিক পরিমান সম্পৃক্ত ফ্যাট থেকে বেচে থাকার জন্য চিনাবাদাম বেছে নেওয়া বেশ ভাল একটি পন্হা হতে পারে।
৩. ডায়েটারি ফাইবার বা খাদ্যজাত আঁশ:
চিনাবাদাম আপনার জন্য ডায়েটারি ফাইবারের খুব সুন্দর এক উৎস হতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রামে আপনি ৮.৫ গ্রাম ফাইবার পাচ্ছেন যা পুরষ ও মহিলার দৈনিক চাহিদার যথাক্রমে প্রায় একচতুর্থাংশ ও একতৃতীয়াংশ।
অ্যামেরিকার ডায়েটারি গাইডলাইন সাম্প্রতিক সময়ে যে পরামর্শ দেয় তা হল- কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক নিম্নলিখিত পরিমানে খাদ্যের সাথে ফাইবার গ্রহন করা উচিত-
- মহিলার ক্ষেত্রে- ২৮ গ্রাম;
- পুরুষের ক্ষেত্রে – ৩৪ গ্রাম;
খাদ্যজাত ফাইবার হার্টের জন্য উপকারি পুষ্টি। AHA এর প্রতিবেদন অনুযায়ি ফাইবারসমৃদ্ধ খাদ্য খেলে রক্তে কোলেস্টেরল এর অবস্থার উন্নতি হয় এবং হৃদরোগ, স্ট্রোক, ওবেসিটি বা শারীরিক স্থুলতা এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যায়।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চিনা বাদামের উপকারিতা:
চিনাবাদামের উপরে উল্লেখিত পুষ্টিগুনের বাইরেও এখানে আরোও কিছু সুনির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান থাকে যা দেহের বিপাকিয় কর্মকান্ডে সহায়তা করে। এছাড়া, কয়েকটি জটিল রোগ প্রতিরোধে ইহা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যেমন-
রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে চিনাবাদাম:
Almond বা কাঠ বাদামের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ করে ডায়াবেটিসের বেলায় রক্তে সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে যে সুখ্যাতি রয়েছে, চিনা বাদামেরও অনুরুপ কার্যকারিতা আছে। এই প্রকার বাদামের সাথে অন্যন্য খাদ্য খাওয়ার পর এর মধ্যে প্রকৃতিগত ভাবে যে চর্বি থাকে তা অন্য সব খাদ্যের গ্লাইসেমিক সূচক কমাতে সহায়তা করে।
এরা উপবাস অবস্থায় ও খাদ্য গ্রহনের পর উভয় অবস্থার মধ্যেই আপনার রক্তে গ্লকোজ লেভেল সঠিক মাত্রায় ধরে রাখতে কাজ করে।
দৈহিক ওজন কমাতে চিনাবাদাম:
চিনাবাদাম ওবেসিটি বা দৈহিক স্থুলতার ক্ষেত্রে অনেক ভাবে আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে। এখানে উপস্থিত ফাইবার ও প্রোটিন আপনার ভিতর ক্ষুধা অনুভুতি দুর করে দেয়। যাকে এক প্রকার ক্ষুধা পরিতৃপ্তির অনুভুতি বলা যায়। যদিও এরা উচ্চ ক্যালরি বিশিষ্ট খাবার তথাপি এর মধ্যে বিদ্যমান এমন কিছু চর্বি থাকে যারা হজম হয়না। ফলে শরীরে শোষণ না হয়েই বেরিয়ে যায়।
এজন্য, ওজন কমানোর যাত্রায় আপনার দৈনিক খাদ্য তালিকায় নির্দেশিত মাত্রায় এই বাদাম রাখতে পারেন।
হৃদরোগের ঝুকি কমাতে চিনাবাদাম:
২০১৬ সালের একটি রিভিউ স্টাডি অনুযায়ি জানা যায়, resveratrol নামের এক এন্টি অক্সিডেন্ট যা এই বাদামে থাকে তা হৃদপিন্ড ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ দুর করতে, রক্তনালী প্রসারিত রেখে রক্ত চলাচল বৃদ্ধিতে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে।
এই বাদামের ফাইবার ও চর্বি হার্টের জন্যও বেশ স্বাস্থ্যসম্মত ও উপকারি। আপনার যদি রক্তচাপজনিত কোন সমস্যা থাকে তাহলে লবন মিশ্রিত বাদাম খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
পিত্ত থলীতে পাথর সৃষ্টির ঝুঁকি কমাতে চিনাবাদাম:
রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে এটি কাজ করে যা পরবর্তিতে পিত্ত থলীতে পাথর তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। পিত্ত থলির পাথর দ্রবিভূত হয়না এমন কিছু কোলেস্টেরলের কারনেও হতে পারে।
এজন্য, সপ্তাহে ৫ বার এই বাদাম বা এর দ্বারা তৈরি মাখন খেলে আপনার পিত্ত থলিতে পাথর তৈরির ঝুঁকি ২৫ শতাংশ কমে যেতে পারে।
Alzheimer’s রোগ নিয়ন্ত্রণে চিনাবাদাম:
এ বাদামে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন-ই, ভিটামিন-বি ও নিয়াসিন থাকে। অনেক মানুষ নিয়ে সম্পাদিত এক গবেষণা ফলাফল থেকে জানা যায়, খাদ্যের নিয়াসিন ৬৫ উর্ধ মানুষের স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়ার লক্ষণ বা cognitive decline অবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমেয়ে দেয়।
যদিও এক্ষেত্রে সাপ্লিমেন্ট যোগ করা তেমন ফলদায়ক হয়না, তবে খাদ্যে বিদ্যমান ভিটামিন-ই যা চিনাবাদামে পাওয়া যায় তা অধিক পরিমানে খেলে Alzheimer’s রোগ হওয়ার ঝুঁকি ৭০% পর্যন্ত কমাতে সহায়তা করে।
চিনা বাদাম খাওয়ার নিয়ম:
- আঙ্গুল বা মেশিনের সাহায্যে এদের খোসা আলাদা করার পর এর ভিতরের অংশ খেতে হয়।
- এই ধরণের বাদামে অনেকটা মিষ্ট স্বাদ থাকে যা ভাজার পর আরোও ভালভাবে বুঝা যায়। বাদাম দানার সাথে লবন বা কিছু মিষ্টান্ন সামগ্রি যোগ করে সুস্বাদু খাবার বানিয়ে খেতে পারেন।
- ভাজা বাদাম ভেঙ্গে আপনি সালাড, ডেজার্ট (desserts) বা অন্যান্য দুগ্ধজাত খাদ্য পন্যের সাথে মিশিয়ে নিতে পারেন।
- সেদ্ধ বাদামে স্বতন্ত্র একটি গন্ধ থাকে যা এর স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। সেদ্ধ বাদামের বেলায় এর পুষ্টিগুন ও এন্টি অক্সিডেন্টের মাত্রা ঠিক থাকে।
- এটি দিয়ে মাখন বানিয়ে খাওয়া যায় যা খাদ্য হিসাবে খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ হয়।
- চিনাবাদাম দিয়ে তেল বানিয়ে খাওয়া যায়।
চিনাবাদাম গাছ কিভাবে চাষ করা হয়?
References:
- Peanuts: Nutrition, health benefits, and comparing types. (2020). Retrieved 29 December 2020, from https://www.medicalnewstoday.com/articles/325003#best-types
- 10 incredible Peanuts nutrition facts and health benefits. (2020). Retrieved 29 December 2020, from https://www.nutrition-and-you.com/peanuts.html
- Peanut Nutrition Facts and Health Benefits. (2020). Retrieved 29 December 2020, from https://www.verywellfit.com/peanuts-and-peanut-butter-are-good-for-your-diet-2506569
- Peanut: leading producers worldwide 2018 | Statista. (2020). Retrieved 29 December 2020, from https://www.statista.com/statistics/1030846/major-producers-of-peanut-worldwide/