ফ্যাটি লিভার রোগ বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন, এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার, এলকোহলিক স্টিটোহেপাটাইটিস (steatohepatitis), নন এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD), নন এলকোহলিক স্টিটোহেপাটাইটিস (NASH) ইত্যাদি।

ফ্যাটি লিভার কি?

লিভার শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ। ইহা খাদ্য হজম করতে সহায়তা করে, শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে ও বিষাক্ত কেমিক্যালস দেহ থেকে অপসারণ করে। ইহা এমন এক রোগ যা লিভারে অতিরিক্ত ফ্যাট জমা হওয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। একজন স্বাস্থ্যবান মানুষের লিভারে স্বাভাবিক অবস্থায় খুব কম পরিমানে ফ্যাটের উপস্থিতি বিদ্যমান।

যখন আপনার লিভারের ওজন অনুপাতে ফ্যাট জমার পরিমান ৫% থেকে ১০% এর মত হবে – তখন ইহা সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত হবে। যাকে ফ্যাটি লিভার রোগ বলা হয়।

ফ্যাটি লিভার কেন ভয়ের কারণ?

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, এই রোগ তেমন কোন মারাত্মক সমস্যা তৈরি করে না। লিভার তার স্বাভাবিক কাজ কর্ম অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু, ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত ৭% থেকে ৩০% মানুষের মাঝে সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এজন্য, রোগটির তিনটি ধাপ বা স্টেজ রয়েছে-

  • ফ্যাটি লিভার গ্রেড ১: যখন আপনার লিভারে প্রদাহের সৃষ্টি হবে, তখন যকৃত কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। এই স্টেজকে স্টিটোহেপাটাইটিস বলে।
  • ফ্যাটি লিভার গ্রেড ২: আপনার লিভারের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেখানে scar tissue তৈরি হবে যাকে ফাইব্রোসিস বলা হয়।
  • ফ্যাটি লিভার গ্রেড ৩ : Scar tissue এর পরিমান যখন বেড়ে যাবে তখন ইহা লিভারের স্বাস্থ্যবান টিস্যুকে প্রতিস্থাপন করবে। এই পর্যায়কে বলা হয় লিভার সিরোসিস। যা লিভারে ব্যাপক ক্ষতি সাধনের পর হয়ে থাকে।

ফ্যাটি লিভার রোগ কয় প্রকার?

এই রোগ মুলত: দুই প্রকার যথা – নন এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার (NAFLD) এবং এলকোহলিক।

নন এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার

নন এলকোহলিক ধরণের রোগটি (NAFLD) মদ্যপানের সাথে সম্পর্কিত নয়। যারা মদ্যপান করেনা তাদের লিভারে যদি অতিরিক্ত ফ্যাট জমা তখন তাকে নন এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার রোগ বলে।

এরা আবার দুই ধরণের হতে পারে-

  • সিম্পল ফ্যাটি লিভার (simple fatty liver): যেখানে লিভারে চর্বি জমা হওয়ার ফলে যকৃত কোষসমুহে কোন প্রদাহের (inflamation) সৃষ্টি করেনা বা করলেও এর মাত্রা খুবই কম থাকে। এতে করে, লিভার কোষে তেমন কোন ক্ষতি হয় না।
  • নন এলকোহলিক স্টিটোহেপাটাইটিস (NASH): এক্ষেত্রে যকৃত কোষে প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। লিভারে এই প্রদাহের ফলে যকৃত কোষ নষ্ট হতে হতে এক পর্যায়ে লিভারে ফাইব্রোসিস বা স্কেরিং (scarring) এর সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তিতে লিভার সিরোসিস (cirrhosis) বা লিভার ক্যানসার পর্যন্ত গড়াতে পারে।

এলকোহলিক ফ্যাটি লিভারে কি হয়?

ইহা অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে হয়ে থাকে। মদ্যপানের অধিকাংশ এলকোহল লিভার ভেঙ্গে ফেলে যা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শরীর থেকে অপসারণ হয়ে যায়। কিন্তু এই এলকোহল ভাঙ্গার সময় কিছু ক্ষতিকর পদার্থে সৃষ্টি হতে পারে যা কিনা লিভার কোষে ক্ষতিসাধন করে, লিভারে প্রদাহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে এবং শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।

যে যত বেশি মদ্যপান করে, তার এ ধরণের ক্ষতির সম্ভাবনাও তত বেড়ে যাবে। লিভারে এলকোহল সম্পর্কিত রোগ সমুহের মধ্যে এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার সবচেয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের রোগ। যার পরবর্তি পর্যায় হল এলকোহলিক হেপাটাইটিস এবং সিরোসিস। লিভারে সৃষ্ট প্রদাহ বা inflammation এর নাম হেপাটাইটিস।

কি কি কারণে ফ্যাটি লিভারের সৃষ্টি হয়?

নন এলকোহলিক ধরণের রোগের কারণ এখনোও জানা যায়নি। তবে, গবেষণা থেকে জানা যায়, ঐসব মানুষের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যারা ইতোমধ্যে নিচে উল্লেখিত রোগসমুহে আক্রান্ত-

  • টাইপ-২ ডায়াবেটিস বা প্রিডায়াবেটিস
  • মাত্রাতিরিক্ত দৈহিক ওজন বা ওবেসিটি
  • মধ্য বয়সি বা চল্লিশোর্ধ বয়সের মানুষ
  • রক্তে কোলেষ্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড অধিক হলে
  • উচ্চ রক্ত চাপ
  • স্টেরয়েড ও কিছু ক্যানসার ড্রাগস
  • বিপাকিয় (metabolic) রোগ বা রোগের লক্ষণ
  • দৈহিক ওজন দ্রুত কমে গেলে
  • ক্রনিক বা দীর্ঘ সময় ধরে হেপাটাইটিস থাকলে বিশেষ করে হেপাটাইটিস সি
  • সুনির্দিষ্ট কিছু টক্সিন

NAFLD বা নন এলকোহলিক ধরণের রোগে বিশ্বের প্রায় ২৫ ভাগ মানুষ আক্রান্ত। যেভাবে বিশ্বব্যাপি মানুষের মাঝে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হাই কোলেস্টেরল এবং ওবেসিটি বেড়ে চলছে, এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ অধিক মাত্রায় এই ধরণের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এটি খুবই সাধারণ রোগ হয়ে গেছে। যার তার মাঝেই দেখা যেতে পারে।

অপরদিকে, এলকোহলিক পর্যায়ের রোগে তারাই আক্রান্ত হয় যারা অধিক পরিমানে মদ্যপায়ী। যারা দীর্ঘ সময় ধরে মদ পান করে আসছে। তবে, মদ্যপায়ী ব্যক্তি মহিলা হলে এবং এর সাথে যদি ওবেসিটি ও সুনির্দিষ্ট কিছু জেনেটিক মিউটেশন থাকে তাহলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক সম্ভাবনা তৈরি হবে।

ফ্যাটি লিভার রোগের লক্ষণ কি?

এলকোহলিক এবং নন এলকোহলিক পর্যায়ের রোগ বাহ্যিকভাবে সাধারণত: কোন লক্ষণ বুঝা যায় না। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক ধরণের ক্লান্তি চলে আসতে পারে।

যখন রোগটি পরবর্তি ধাপ সমুহে অগ্রসর হতে থাকে যেমন সিরোসিস – তখন বিভিন্ন প্রকার জটিলতা ও লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। যেমন-

  • পেটের উপরিভাগের ডান পাশে যেখানে লিভার অবস্থিত সেখানে মৃদু ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে।
  • ক্ষুধা মন্দা
  • বমি বমি ভাব
  • পেট এবং পা ফুলে যাওয়া
  • শরীরের ত্বকের নিচে রক্ত নালী প্রসারিত হয়ে হওয়া
  • পুরুষের বক্ষ দেশ স্বাভাবিকের তুলনায় বড় হয়ে যাওয়া
  • শরীরের ত্বক এবং চোখ হলুদ বর্ণ ধারণ করা যা জন্ডিসের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
  • প্রচন্ড রকমের দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভব হওয়া

কিভাবে ফ্যাটি লিভার রোগ নির্নয় করা হয়?

যেহেতু বাহ্যিক ভাবে ফ্যাটি লিভার রোগের লক্ষণ বোধগম্য হয়না, তাই এর ডায়াগনোসিস ততটা সহজনয়। এর জন্য চিকিৎসকগণ বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ইহা সনাক্ত করতে পারেন।

যেসব প্রক্রিয়ায় ফ্যাটি লিভার রোগ নির্নয় করা হয় তা হল-

  • স্বাস্থ্যগত ইতিহাস: চিকিৎসক আপনাকে মদ্যপান করেন কিনা জিজ্ঞাসা করবে। এই প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে আপনার এলকোহলিক আর নন এলকোহলিক ফ্যাটি লিভারের মধ্যে কোনটি হতে পারে তা জানা যাবে। কাজেই, এই প্রশ্নের উত্তরে অবশ্যই আপনার সত্যবাদি হতে হবে।এর বাইরে, আপনি কি কি মেডিকেশন খাচ্ছেন তার ইতিহাস নেওয়া হবে। কারণ, কিছু মেডিসিন এমন আছে যা ফ্যাটি লিভার রোগ তৈরিতে কাজ করে। এরপর,আনুসঙ্গিক বিষয় যেমন, খাদ্যাভ্যাস, অন্য কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যা আছে কিনা বা আপনি ইতিপূর্বে জটিল কোন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা সে বিষয়ে তথ্য নেওয়া হতে পারে।
  • শারীরিক পরীক্ষা বা physical exam: আপনার দৈহিক ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী কিনা তা মেপে পরীক্ষা করা হবে। আপনার লিভার সমস্যার কোন লক্ষণ আছে কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখা হবে। যেমন লিভারের আকার বৃদ্ধি পাওয়া বা জন্ডিসের লক্ষণ রয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয় পরীক্ষা করে দেখা হবে।
  • রক্তপরীক্ষা: রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার দেহে লিভার এনজাইম যেমন এমাইনোট্র্যান্সফারেজ এবং এসপারটেটট্র্যান্সফারেজ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী কিনা তা বুঝা যাবে। যদি এই এনজাইম রক্তে অধিক পরিমানে পাওয়া যায় তা হলে ধরে নিতে হবে, আপনার লিভারে সমস্য আছে।
  • ইমেজিং টেষ্ট: আলট্রাসাউন্ড, কম্পিউটারাইজড টোমোগ্রাফি (CT) স্ক্যান অথবা মেগনেটিক রিজোনেন্স ইমেজিং (MRI) – এই সব টেষ্টসমুহের মাধ্যমে আপনার লিভারে ফ্যাট এর উপস্থিতি সনাক্ত করা যাবে। কিন্তু এর মাধ্যমে সিম্পল ও নন এলকোহলিক স্টিটোহেপাটাইটিস এর মধ্যে পার্থক্য বুঝা যাবেনা।
  • লিভার বায়োপসি:

ফ্যাটি লিভার রোগের চিকিৎসা কি?

নন এলকোহলিক ফ্যাটি লিভারের জন্য চিকিৎসক আপনার দৈহিক ওজন কমানোর পরামর্শ দিতে পারেন। ওজন হ্রাসের ফলে লিভারে ফ্যাট এর পরিমান, প্রদাহ এবং ফাইব্রোসিস এর মাত্রা কমে যাবে।

আপনার এই রোগ যদি সুনির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনের দ্বারা হয়ে থাকে বলে চিকিৎসক মনে করেন, তাহলে আপনাকে ঐসব ঔষধ পরিত্যাগ করতে হবে। তবে, এর বিকল্প ঔষধের ব্যবস্থা ডাক্তার বলে দিবেন।

এলকোহলিক ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসার সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ দিক হল, সর্বপ্রথম মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হবে।

এলকোহলিক ফ্যাটি লিভারে এবং নন এলকোহলিক স্টিটোহেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে এরা এক পর্যায়ে সিরোসিসে টার্ন নিতে পারে। তখন চিকিৎসক এর ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্য জটিলতার লক্ষণ মাথায় রেখে মেডিসিন দিতে পারেন যা সহায়ক বা সাপোর্টিভ চিকিৎসার ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া, অস্ত্রপচার করতে পারেন এবং যদি সিরোসিসের ফলে লিভার ফেইলিউর হয় তখন আপনার লিভার ট্র্যান্সপ্লেন্ট এর প্রয়োজন হবে।

ফ্যাটি লিভারের ঔষধ আছে কি?

NAFLD এর জন্য এখন পর্যন্ত অনুমোদিত কোন ঔষধ নেই। তবে, গবেষকগন অনুসন্ধান করে দেখার চেষ্টা করছেন যে, ডায়াবেটিসের কিছু ঔষধ এবং ভিটামিন-ই এক্ষেত্রে কোন সহায়তা করতে পারে কিনা। বিষয়টি দেখার জন্য আরোও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগন মনে করেন।

ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায় কি?

নিম্নলিখিত বিষয়সমুহ মেনে চলা এই রোগ থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে বিবেচিত।

  • স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য খাওয়া: ফ্যাটি লিভারের ডায়েট চার্ট অনুযায়ি খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। যেখানে উদ্ভিদজাত খাদ্য যেমন ফলমুল, শাক-সবজি, whole grain এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি খাওয়ার উপর গুরত্ব দেওয়া হয়েছে।
  • দৈহিক ওজন স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা: মানুষের দৈহিক ওজন তার বয়স ও উচ্চতা ভেদে বিভিন্ন রকম হয়। আপনার দৈহিক ওজন উচ্চতা অনুযায়ি সঠিক আছে কিনা তা জেনে নিন। এরপর, ওজন মেপে পরীক্ষা করুন – তা স্বাভাবিকের চেয়ে কম না বেশী। যদি আপনার দৈহিক ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী হয় তাহলে তা স্বাভাবিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার জন্য দৈনিক কত ক্যালরি খাদ্য খেতে হবে তা জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীর চর্চা করা: এই রোগ থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে আপনাকে দৈনিক ফ্যাটি লিভারের ব্যায়াম করতে হবে। কি কি ব্যায়াম কিভাবে করলে রোগটি থেকে মুক্তির উপায় হতে পারে তার উপর অপর এক পোষ্টে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।