ডায়াবেটিস কেন হয় – বিষয়টির উপর কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে চলে এলাম আপনাদের মাঝে। প্রথমেই চলুন জেনে নেই রোগটি সম্পর্কে কিছু গুরত্বপূর্ণ কথা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে –

১) বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্য যেখানে ১৯৮০ সালে ছিল ১.০৮ কোটি সেখান থেকে ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪.২২ কোটি মানুষ। মুলত নিম্ন ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এর প্রাদুর্ভাব দ্রুত বেড়ে চলেছে।

২) অন্ধত্ব, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং পায়ের নিচের অংশ কেটে ফেলা ইত্যাদি অবস্থা তৈরির একটি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ডায়াবেটিস।

৩) ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বয়স ভেদে ডায়াবেটিসে মৃত্যুর হার শতকরা ৩% বেড়েছে।

৪) ডায়াবেটিস এবং এর কারণে সৃষ্ট কিডনি রোগে ২০১৯ সালে বিশ্বে প্রায় ২০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছে।

৫) স্বাস্থ্য সম্মত খাবার, নিয়মিত শরীর চর্চা, দেহের স্বাভাবিক ওজন ধরে রাখা, ধুমপান পরিহার করা প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে আপনি টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া দমিয়ে রাখতে পারেন।

এবারে, ডায়াবেটিস সম্পর্কে একটু প্রাথমিক ধারণা নেওয়া দরকার।

এটি একটি ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি রোগ। ডায়াবেটিস কেন হয় তার প্রধান কারণ দু’টি। প্রথমত, যখন দেহের প্যানক্রিয়াস নামের গ্রন্থি পর্যাপ্ত পরিমানে ইনসুলিন উৎপাদনে ব্যর্থ হয়। আর, দ্বিতীয়ত: প্যানক্রিয়াস হতে উৎপাদিত ইনসুলিন আপনার দেহ যদি ব্যবহার করতে না পারে। অর্থাৎ কিনা, ইনসুলিন ব্যবহারের শারীরিক সামর্থ্য যদি নষ্ট হয়ে যায়।

ইনসুলিন এক প্রকার হরমোন যা রক্তে গ্লুকোজ বা সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের একটি প্রধান ফলাফল হচ্ছে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যাওয়া। যার ফলে একটি সময়ে তা দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। বিশেষ করে স্নায়ু তন্ত্র এবং রক্ত নালীর উপর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অপর এক প্রতিবেদনে পাওয়া যায়, ২০১৪ সালে ৮.৫% প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যারা ১৮ বছর বা তার উর্ধে, তাদের ডায়াবেটিস পাওয়া গিয়েছে। ২০১৯ সালে, ১৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সরাসরি কারণ হিসাবে ডায়াবেটিস রোগটি চিহ্নিত হয়েছে।

যাহোক, রোগটির গুরত্ব অনুধাবনের জন্য তথ্যগুলো উপস্থাপন করা হলো।

বাংলাদেশেও রয়েছে রোগটির বিশাল থাবা। ডায়াবেটিস রোগে সৃষ্ট জটিলতায় মৃত্যু বরণ করছে বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ।

তাই, রোগটি সম্পর্কে আমাদের পূর্ব থেকেই সতর্ক হয়ে চলা দরকার। এর জন্য দরকার জন সচেতনতা। তারই অংশ হিসাবে আমার কথা বলা। কারণ, আপনি আগে থেকে যদি রোগটি নিয়ে সচেতন হয়ে চলতে পারেন, তাহলে অনেকাংশেই এর নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

ডায়াবেটিস কেন হয়?

ডায়াবেটিস কেন হয় এর কারণ বুঝতে হলে প্রথমেই আপনাক জেনে নিতে হবে দেহের রক্তে কিভাবে গ্লুকোজ সরবরাহ হয়। তারপর শরীর কিভাবে রক্তে মিশ্রিত এই গ্লুকোজ প্রক্রিয়াজাত করে এবং এই দেহে গ্লুকোজ ব্যবহারের স্বাভাবিক দৈহিক সামর্থ বলতে কি বুঝায়? অর্থাৎ গ্লুকোজ কিভাবে আপনার দেহে স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হয়? শরীরে গ্লুকোজ ও ইনসুলিনের পারস্পরিক ভূমিকা কি, ইত্যাদি।

আসুন ডায়াবেটিস কেন হয় তার উত্তর খুঁজার জন্য বিষয়গুলি নিয়ে একে একে আলোচনা করি-

রক্তে কিভাবে গ্লুকোজ সরবরাহ হয়?

প্রথমে রক্তে গ্লুকোজের উৎস সম্পর্কে জেনে নেওয়া ভাল। আমরা যে খাদ্য খেয়ে থাকি তার মধ্যে শর্করা জাতীয় খাদ্য হচ্ছে রক্তে গ্লুকোজের উৎস। শর্করা জাতীয় খাদ্যের কয়েকটি প্রধান উদাহারণ হল- ভাত, রুটি, চিড়া, মুরি প্রভৃতি। এই খাদ্যগুলো খাওয়ার পর পাকস্থলিতে হজম প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। হজম শেষে এর সারাংশ অর্থাৎ গ্লুকোজ ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রাচীর থেকে শোষিত হয়ে রক্তে মিশে যায়। এভাবে রক্তে প্রতিনিয়ত গ্লুকোজ সরবরাহ হতে থাকে।

ইনসুলিন কিভাবে গ্লুকোজের উপর কাজ করে?

অপরদিকে, রক্তে গ্লুকোজ পৌঁছানোর পর ইনসুলিন এর ভুমিকা শুরু হয়ে যায়। ইনসুলিন একটি হরমন যা পেনক্রিয়াসের বিশেষ এক প্রকার কোষ থেকে নি:সৃত হয়ে রক্ত স্রোতে মিশে যায়। তারপর, এই ইনসুলিন রক্তে বিদ্যমান গ্লুকোজকে শরীরের কোষে প্রবেশ করাতে সহায়তা করে। এইভাবে, ইনসুলিন রক্তের গ্লুকোজকে কোষে পাঠিয়ে দিয়ে রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমান স্বাভাবিক রাখে।

গ্লুকোজ ও ইনসুলিনের পারস্পরিক ভূমিকা কি?

রক্তে গ্লুকোজের পরিমান অনুযায়ি পেনক্রিয়াস হতে প্রয়োজনমত ইনসুলিন সরবরাহ করার নাম হচ্ছে গ্লুকোজ প্রক্রিয়াজাতকরণের স্বাভাবিক শারীরিক সামর্থ।

এবারে আসুন, গ্লুকোজ কিভাবে শরীরে ব্যবহৃত হয়, সে প্রসঙ্গে কথা বলা যাক। আমরা ইতিমধ্যে এতটুকু জানতে পেরেছি যে, ইনসুলিনের মাধ্যমে রক্ত থেকে গ্লুকোজ শরীরের কোষসমুহে পৌছে যায়। গ্লুকোজ কোষে পৌঁছানোর পর কোষ অভ্যন্তরে একাধিক বায়ো কেমিক্যাল ধাপ অনুসরনের মাধ্যমে বিপাকীয় প্রক্রিয়া সমাপ্তির পর গ্লুকোজ থেকে শক্তি উৎপন্ন হয়।যে শক্তি প্রাপ্তির মাধ্যমে আমরা পার্থিব জীবনের যাবতীয় কাজ কর্ম করে থাকি।

এই ইনসুলিন হরমনটি তৈরি হয় শরীরের অভ্যন্তরের পেনক্রিয়াস এর বিটা সেল থেকে।এখন কোনভাবে যদি পেনক্রিয়াস তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারানোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমানে ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হয় তখন রক্তে আগত গ্লুকোজ প্রক্রিয়াজাত হতে পারেনা। ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। একই সাথে রক্তে গ্লুকোজ অব্যবহৃত হিসাবে থেকে যাওয়ার ফলে শরীরের কোষগুলি স্বাভাবিক শক্তি লাভ করা থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলে শরীরে দুর্বলতার সৃষ্টি হয়।

ডায়াবেটিসের প্রতিকার কি?

আপনি যদি একজন স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে খুব সহজেই এটি থেকে বেচে থাকতে পারেন। তবে, জেনেটিক বা বংশগত কোন কারণ থাকলে সেটি ভিন্ন কথা। ডায়াবেটিস প্রতিকারের সবচেয়ে বড় ও কার্যকরি উপায় হলো লাইফ স্টাইল পরিবর্তন। আপনাকে স্বাস্থ্য সম্মত জীবন ধারণ পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে হবে।

এর সাথে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করাও খুব গুরত্বপূর্ণ। যদি আপনি প্রথম থেকেই নিয়ম মেলে চলা শিখতে পারেন, তাহলে শুধু ডায়াবেটিসই নয়, এর সাথে সাথে আরোও অনেক জটিল রোগ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হবে।

সারকথা

ডায়াবেটিস কেন হয়, তার সার কথা হচ্ছে দেহের পাকস্থলীর পিছনে একটি গ্রন্থি থাকে। তার নাম হলো পেনক্রিয়াস। এই পেনক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নামের হরমোনের নিঃসরণ ঘটে।

খাদ্যের হজম প্রক্রিয়া শেষে খাদ্যের সার অংশ হিসাবে পরিচিত এই গ্লকোজ অন্ত্র থেকে রক্তে শোষিত হয়। আর ইনসুলিন হরমোনের কাজ রক্তে মিশ্রিত এই সুগার পরিবহন করে দেহের কোষ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। এরপর, কোষের ভিতরে ইহা শক্তিতে রুপান্তরিত হয় যা দিয়ে আমরা দৈনন্দিন কাজ কর্ম সারতে পারি। এভাবেই রক্তে গ্লুকোজের পরিমান স্বাভাবিক থাকে।

এখন কোন কারণে যদি পেনক্রিয়াস প্রয়োজন মত ইনসুলিন নিঃসরণে ব্যর্থ হয় অথবা আপনার দেহ ইনসুলিন যথাযথভাবে ব্যবহার করতে না পারে, ঠিক তখনই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে এটিই হচ্ছে ডায়াবেটিসের মুল কারণ।

উপরের আলোচনা থেকে জানা গেল ডায়াবেটিস কেন হয় এবং ডায়াবেটিসের প্রতিকার এর উপায়। বর্ণিত তথ্যের আলোকে কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টের মাধ্যমে জানানোর অনুরোধ করছি।