মেথির উপকারিতা বলার আগে মেথি সম্পর্কে একটি ধারনা নেওয়া ভাল। আপনি নিশ্চয়ই মেথির নাম শুনে থাকবেন। এর ভিতর এমন কিছু ফাইটোক্যামিকেল জাতীয় উপাদান থাকে যা শরীরের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এই আর্টিকেলে মেথি কি, এর পুষ্টি উপাদান, মেথির উপকারিতা, মেথির ক্ষতিকর দিক ও মেথি খাওয়ার নিয়ম ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে।

মেথি কি?

মেথি হল এক প্রকার লিগিউম জাতীয় গাছ। ইংরেজিতে একে fenugreek বলা হয়। এর লতা-পাতা ও বীজ ভারতীয় উপমহাদেশে সবজি প্রকৃতির খাদ্য হিসাবে খুব সমাদৃত। এই অঞ্চলে ইহা মেথি নামে পরিচিতি লাভ করে।

মেথির উপকারিতা

গাছটি সারা বিশ্ব ব্যাপী চাষ করা যায়। তবে, ইহা ভূমধ্যসাগড়ীয় অঞ্চল, দক্ষিণ ইউরোগ এবং পশ্চিম এশিয়া বেশি উৎপাদিত হয়। ইহা clover ধরনের গাছের যার এক বোটায় তিন পাতা থাকে। মেথি থেকে মুলত: ভেষজ জাতীয় ঔষধ তৈরি করা হয়।

বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও মেথি ডায়াবেটিস, হাই কোলেস্টেরল এবং আরোও অনেক রোগের চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। খাদ্যে অনেক সময় সুগন্ধ বৃদ্ধির কাজেও ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, উৎপাদন ধর্মী শিল্প প্রতিষ্ঠান যেমন সাবান, কসমেটিকস ইত্যাদি তৈরিতে মেথির নির্যাস ব্যবহার করা হয়।

মেথির পুষ্টি উপাদান সমুহ

ইদানিংকালে, মেথির অসাধারণ পুষ্টিগুনের কারণে মানুষের মাঝে মেথি গ্রহনের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। আনুপাতিক হারসহ এর প্রধান প্রধান পুষ্টি উপাদানগুলোর নিম্নরুপ-

  • ডায়েটারি ফাইবার- ৬৫%;
  • কার্বোহাইড্রেট- ৪৫%;
  • প্রোটিন- ৪১%;
  • ফ্যাট- ২১%
  • ফাইটোক্যামিকেলস জাতিয় পদার্থ।

১০০ গ্রাম মেথির ভিতর পুষ্টি উপাদান নিম্নরুপ:

  • কার্বোহাইড্রেট- ৫৬ গ্রাম;
  • প্রোটিন- ২৩ গ্রাম;
  • ফ্যাট- ৬.৪ গ্রাম;
  • ফাইবার- ২৫ গ্রাম
  • ক্যালসিয়াম- ১৭৫ মিলিগ্রাম;
  • কপার- ১ মিলিগ্রাম;
  • আয়রন- ৩৪ মিলিগ্রাম;
  • ম্যাগনেসিয়াম- ১৯০ মিলিগ্রাম;
  • ফসফরাস- ৩০০ মিলিগ্রাম;

এছাড়াও রয়েছে ইলেক্ট্রোলাইটস ও ভিটামিন। মেথির ভিতর বিদ্যমান ফাইটোক্যামিক্যালসগুলো মুলত: ডায়াবেটিস, প্রদাহজনিত অবস্থায়, যকৃত সুরক্ষার কাজে, ক্যানসার প্রতিরোধে, স্নায়তন্ত্রের চিকিৎসায় ভূমিকা পালন করে। এছার মেথি এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবেও কাজ করে।

মেথির উপকারিতা

স্বাস্থ্যগত বিচারে মেথির অনেক উপকারিতা আছে কিন্তু এর স্বপক্ষে উপস্থাপনযোগ্য তেমন কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে, যেহেতু বিভিন্ন ধরণের রোগ নিরাময়ে শত শত বছর ধরে মেথি ব্যবহৃত হয়ে আসছে তাই এর উপর পর্যাপ্ত গবেষণার প্রয়োজন। কারণ, মেথি ব্যবহারে ফল না পাওয়া গেলে যুগ যুগ ধরে মানুষ এর ব্যবহার ধরে রাখতনা।

যাহোক, নিচে মেথির উপকারিতা সংক্ষিপ্ত আকারে পেশ করা হল-

  • বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্ষুধা মন্দা, পাকস্থলিতে প্রদাহ ইত্যাদির ক্ষেত্রে।
  • মায়ের বুকের দুধ উৎপাদন বাড়াতে;
  • ডায়াবেটিস এর চিকিৎসায়;
  • টেসটোস্টেরণ হরমন তৈরি বৃদ্ধির কাজে যা পুরুষের যৌন আকাংখা বাড়াতে কাজ করে;
  • মেয়েদেরে মাসিক চক্রের কোন সমস্যার ক্ষেত্রে;
  • Menopause
  • শরীরের গিরায় প্রদাহ হলে;
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • দৈহিক ওজন অস্বাসাভাবিক পর্যায়ে বেড়ে গেলে;
  • শ্বাসকষ্টজনিত কোন সমস্যা হলে
  • আলসার এর চিকিৎসায়;
  • মাংসপেশিতে ব্যথা হলে
  • মাইগ্রেনস এর কারণে মাথা ব্যাথা হলে;

উপরে উল্লেখিত সমস্যাগুলির মধ্যে মাত্র কয়েকটি ব্যাতিত অধিকাংশের ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রমান পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা কাজ এখনোও সম্পন্ন করা যায়নি।

মেথির উপকারিতা নিয়ে কিছু গবেষণা থেকে যেসব বিষয় জানা যায়, তা হল –

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের কাজে

কয়েকটি গবেষণায় পাওয়া যায় যে, মেথির কমপক্ষে চারটি উপাদান এমন আছে যার ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে কাজ করার প্রবনতা থাকে। যা নিম্নরুপ-

  • গেস্ট্রো ইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টের ক্ষুদ্রান্তের মাধ্যমে গ্লুকোজ শোষণ এর মাত্রা কমিয়ে দেওয়।
  • পাকস্থলিতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত খাদ্য ধরে রাখার মাধ্যমে ক্ষুধার প্রবনতা থামিয়ে রাখা।
  • ইনসুলিন হরমোনের সংবেদনশীলতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা।
  • শরীরে লিপিডযুক্ত প্রোটিনের ঘনত্ব কমিয়ে দেওয়া।

2017 সালের এক গবেষণায় দেখা যায় উচ্চ চর্বি সমৃদ্ধ খাবারের সাথে ২% মেথি বীজের সাপ্লিমেন্ট মিশিয়ে ১৬ সপ্তাহ যাবত ইদুরকে খাওয়ানো হয়। এরপর দেখা যায় তাদের মাঝে গ্লুকোজের প্রতি অধিক পরিমানে সহনশীলতার প্রবনতা লক্ষ করা যায় ঐ সব ইদুরের তুলনায় যাদের এইরুপ খাওয়ানো হয় নাই।

সার্বিকভাবে বলা যায়, পর্যাপ্ত গবেষণার অভাবে গবেষকগন প্রত্যাশার তুলনায় মেথির উপকারিতা বিষয়ে খুব কমই ফলাফল পেয়েছে।

বুকের দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে

মেথি মায়ের বুকের দুধের উৎপাদন ও একই সাথে এর প্রবাহ বৃদ্ধির কাজে ভূমিকা পালন করে। এশিয়া অঞ্চলের চিকিৎসকগন সাধারণত: এই উদ্দেশ্যে মেথি খাওয়ার জন্য পরামর্শ প্রদান করে।

২০১৪ সালের অপর এক গবেষণায় সদ্য বাচ্চা প্রসব করা এমন ২৫ জন মহিলা যাদের দৈনিক তিন কাপ করে মেথি মিশ্রিত চা ২ সপ্তাহ ধরে পান করানো হয়। এর প্রথম সপ্তাহ পর তাদের দুধ উৎপাদন বেড়ে যাওয়া বিষয়টি নজরে আসে।

ওজন কমাতে

মেথির উপকারিতা বিষয়ে ইহা বেশ গুরত্বপূর্ণ। মেথি পেট ভরা অনুভুতি অনেক সময় পর্যন্ত বহাল রাখে। ফলে, আপনার ভিতর ক্ষুদা মন্দা ভাব তৈরিতে সহায়তা করে। ওজন কমানোর সাধারণ নিয়ম হল, যত কম খাওয়া যায় তত ভাল। এতে আপনার দৈনিক ক্যালরি গ্রহন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এর ফলে শরীরের সঞ্চিত চর্বি যা মুলত: পেটের চতুস্পার্শে জমা থাকে সেখান থেকে এক পর্যায়ে চর্বি ভেঙ্গে ক্যালরির যোগন দেয়। যদি কম খাওয়ার ফলে  দৈনিক ক্যালরি গ্রহনের হার আপনার দৈহিক প্রয়োজনের চেয়ে কম হয়।

অপর এক গবেষণায় ২০১৫ সালে কোরিয়ান ৯ জন অস্বাভাবিক ওজনধারি মহিলাকে দুপুরের খাবারের পূর্বে মেথি মিশ্রিত চা পান করানোর পর তাদের ক্ষুধা লাগার অনুভূতি কমে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ করা যায়। এর কারণ হতে পারে মেথির ভিতরে ফাইবারের উপস্থিতি যা দ্রুত হজম হতে পারে না। ফলে, এক প্রকার পেট ভরে থাকার প্রবনতা কাজ করে।

টেসটোস্টেরণ হরমন তৈরিতে

যাদের টেসটোস্টেরণ হরমন এর পরিমান কম তাদের টেসটোস্টেরণ হরমন উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মেথি কাজ করে। এছাড়া, শুক্রানু গননায় এর সংখ্যা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে।

২০১৭ সালে এক গবেষণায় ৫০ জন পুরুষ মানুষকে ১২ সপ্তাহ ধরে মেথির নির্যাস খাওয়ানো হয়েছিল। এতে, তাদের sperm count উন্নতির বিষয়ে প্রমান পাওয়া গিয়েছিল।

প্রদাহ কমাতে মেথি

মেথির ভিতর যথেষ্ট পরিমানে এন্টিঅক্সিডেন্ট উপস্থিত থাকায় ইহা প্রদাহজনিত সমস্যায় খুব ভাল কাজ করে। ২০১২ সালে ইদুরের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় এর প্রমান পাওয়া যায়।

হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে

শরীরে কোলেস্টেরলরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে মেথি কাজ করে। এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়। এর কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে, মেথির ভিতর ৪৮% ডায়েটারি ফাইবারের উপস্থিতি রয়েছে। যার পাকস্থলিতে হজম প্রক্রিয়া খুব কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। এছাড়া, মেথি ক্ষুদ্রান্তে যাওয়ার পর এক ধরণের আঠালো জেলির ন্যায় পদার্থে পরিনত হয় যার ফলে সেখান থেকে ‍অতিরিক্ত সুগার ও চর্বি শোষন হতে পারে না।

ব্যাথা দুরীকরণের কাজে

ধারাবাহিক চিকিৎসার বাইরে শরীরের ব্যাথা নিরসণে মেথি দীর্ঘ সময় থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গবেষকগন মনে করেন, মেথির ভিতরে এলকালয়েড জাতীয় যে উপাদন রয়েছে তা স্নায়ু তন্ত্রের সেন্সরি রিসিপ্টরকে ব্লক করে দেয়। ফলে, মস্তিষ্কে ব্যথার অনুভূতি কমিয়ে দেয়।

মেথির ক্ষতিকর দিক বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

মেথির উপকারিতা যেমন আছে তেমনি মেথি খাওয়ার পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেথির ক্ষতিকর দিক বা মেথির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও পরিলক্ষিত হয়। মেথির অপকারি দিক গুলো নিচে উল্লেখ করা হল:

  • ডায়ারিয়া
  • পাকস্থলির কার্যক্রম কমিয়ে দেওয়া
  • ঘামে, বুকের দুধ ও মুত্রে ম্যাপল এর মত বা বৃক্ষ বিশেষের গন্ধ টের পাওয়া;
  • তন্দ্রাচ্ছন্নতা;
  • মাথা ব্যথা;

বিরল ক্ষেত্রে কোন কোন মানুষের মাঝে মেথি খাওয়ার পর এলার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার উদাহারণ রয়েছে। গর্ভাবস্থায় মহিলাদের ম্যাথি খাওয়া নিরাপদ নয়। গর্ভবতী মহিলাদের ম্যাথি খাওয়ার পর গর্ভপাতের ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ, মেথির ভিতর এমন পদার্থ রয়েছে যা জরায়ুর মাংস পেশি সংকোচনে কাজ করে। ফলে গর্ভপাত ঘটতে পারে বা বাচ্চ প্রসবের সময় নবজাত শিশুর ভিতর জটিলতা তৈরি করতে পারে।

মেথির কাজ অনেকটা ইস্ট্রোজেন নামক হরমোনের মত। কাজেই, হরমোনের প্রতি সংবেদনশীল এমন ধরণের ক্যানসারে আক্রান্ত কোন ব্যক্তির মেথি খাওয়া উচিত হবে না।

সাধারণ দৃষ্টিকোন থেকে, কোন মানুষের যদি স্বাস্থ্যগত কোন সমস্যা থাকে তবে মেথি ব্যবহারের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করুন।

কোন ঔষধ বা ড্রাগসের সাথে মেথির কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। তবে, ভেষজ জাতীয় অন্যান্য ঔষধের সাথে মেথির কাজের সাদৃশ্যতা থাকতে পারে। কাজেই, অন্যান্য হারবাল ঔষধের সাথে এক সাথে মেথি খাওয়ার আগে সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন।

অতিরিক্ত মাত্রায় মেথি খেলে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা বুঝার জন্য আরোও গবেষণার প্রয়োজন। তবে, নিয়মিত স্বল্পমাত্রায় মেথি খাওয়া অনেকটাই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত বলে বিবেচিত হয়।

মেথি খাওয়ার নিয়ম

আপনি ইতোমধ্যে মেথির উপকারিতা বিষয়ে অনেক কিছু জেনে গেছেন। যদিও মেথির অপকারি দিক বা কিছুটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে যা প্রত্যেক ঔষধের ভিতরই কমবেশি থেকে থাকে। তবে, নিয়ম মেনে যদি আপনি মেথি খেতে পারেন তাহলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরির কোন সুযোগ থাকবে না।

এবারে, আমরা মেথি খাওয়ার নিয়ম এর উপর আলোচনা করব। আপনি নিচের কয়েকটি উপায়ে মেথি খেতে পারেন-

  • এক কাপ পানিতে মেথি বীজ নিয়ে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। তারপর, খালি পেটে খেয়ে নিন।
  • অংকুরিত মেথি বীজ সালাদের মত বানিয়ে খেতে পারেন।
  • মেথি বীজ শুকিয়ে তারপর ভেঙে গুরো করে তরকারি রান্নার সময় মসলা হিসাবে কিছু পরিমানে ব্যবহার করতে পারেন।
  • চা যেমন আদার সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়, ঠিক একই ভাবে আপনি চা বানানোর সময় কিছু মেথি যোগ করে খেতে পারেন।

Reference:

  1. Huizen, J., 2021. Fenugreek: Benefits and effects. [online] Medicalnewstoday.com. Available at: <https://www.medicalnewstoday.com/articles/324334#benefits> [Accessed 16 March 2021].