Last updated on May 14th, 2023 at 05:34 am
স্ক্রীন প্রিন্টিং নামটি পরিচিত শোনালেও আমরা অনেকে জানিনা বিষয়টি আসলে কি। তাই এটি নিয়ে আজ লেখতে বসলাম।
তবে, আপনি যদি এ বিষয়ে নতুন হয়ে থাকেন, তাহলে এটি জানার আগে আপনার জানা প্রয়োজন টেক্সটাইল প্রিন্টিং কাকে বলে এবং কত প্রকার।
সহজে বলতে গেলে, রং বা কালি একটি স্টেনসিল করা মেশ বা জালির ভেতর দিয়ে প্রবেশ করিয়ে নকশা প্রিন্ট করার পদ্ধতিই হলো স্ক্রীন প্রিন্টিং। এটা প্রিন্টিং জগতে খুবই প্রচলিত একটা পদ্ধতি।
অনেক ধরনের শিল্প কারখানায় এই পদ্ধতিতে প্রিন্ট করা হয়। তাই, আপনি যদি স্ক্রীন প্রিন্টিং এর নাম নাও শুনে থাকেন, শতভাগ সম্ভাবনা আছে যে আপনি স্ক্রীন প্রিন্টিং করা পণ্য ব্যবহার করেছেন এবং করছেন। এটাকে অনেকসময় সেরি গ্রাফি বা সিল্ক স্ক্রীন প্রিন্টিংও বলা হয়ে থাকে। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, প্রিন্টিং করার পদ্ধতি মোটামুটি একই।
বড় ক্যানভাস, পোস্টার বা চিত্রকর্ম তৈরী করতে স্ক্রীন প্রিন্টিং খুবই কার্যকর। এছাড়া, কাপড় বা টেক্সটাইলে প্রিন্ট করতেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। এমনকি, শুধু কাপড় নয়, বরং বিভিন্ন পণ্যের উপর উৎপাদকের নাম, লোগো বা যে কোন কিছু প্রিন্ট করতে স্ক্রীন প্রিন্টিং খুব সুবিধাজনক।
আজকে আমরা স্ক্রীন প্রিন্টিং করার বিভিন্ন ধাপসমূহ বিস্তারিতভাবে জানবো। তার আগে এ সম্পর্কে আরও কিছু বলে জানিয়ে রাখি।
স্ক্রীন প্রিন্টিং আসলে কি?
এটি হলো টেক্সটাইল জগতে কাপড় বা ফেব্রিকস এর উপর প্রিন্টিং এর একটা পদ্ধতি। একটা মেশ বা কাপড়ের জালির মতো স্ক্রীনের ভিতর দিয়ে চাপ দিয়ে রং বা কালি বের করা হয়। সেই রং কাপড় বা কাগজের উপর পড়ে। মেশ বা জালির স্ক্রীনে যে নকশা থাকে, তাই কাপড় বা কাগজে পড়ে।
মেশ বা জালির স্ক্রীনের নকশা আগেই করা হয় স্টেনসিল করে। কাপড় বা কাগজে স্ক্রীন প্রিন্টিং এর মাধ্যমে নকশা করাটা খুবই প্রচলিত। তবে বিশেষ কালি বা রং ব্যবহার করে মেশ এর নকশা কাঠ, ধাতু, প্লাস্টিক এমনকি কাচের উপরও বসানো যায়।
এই পদ্ধতির মূল কথা হলো, নকশা বা স্টেনসিল করা মেশ মাধ্যমের ভেতর দিয়ে রং পৌছে সেই নকশাটিই ছাপা হবে কাপড়, ক্যানভাস, কাগজ বা অন্য কিছুর উপর।
সিল্ক স্ক্রীনিং, সিল্ক স্ক্রীন প্রিন্টিং ইত্যাদি গালভরা নাম থাকলেও কাজ মূলত একই। যা একটু ভিন্ন হয়, তা হলো স্টেনসিল করার পদ্ধতিতে, অথ্যাৎ, মেশ বা জালির মাধ্যমের উপর নকশা বসানোর পদ্ধতিতে। স্টেনসিল করার কয়েকটি পদ্ধতি হলোঃ
১. মেশ এর অপ্রয়োজনীয় অংশকে টেপ বা ভিনাইল দিয়ে ঢেকে রাখা
২. মেশ এর উপর স্ক্রীন ব্লকার জাতীয় পদার্থ যেমন আঠা বা লিকার দিয়ে একে নেয়া
৩. আলোক সংবেদনশীল পদার্থ দিয়ে মেশ এর উপর প্রলেপ দিয়ে ফটো ডেভেলপ করার মতো করে ডেভেলপ করা।
স্ক্রীন প্রিন্টিং সাধারণত এক রংয়ে করা হয়। একাধিক রংয়ে প্রিন্টি করতে হলে প্রত্যেক রংয়ের জন্য আলাদা আলাদা মেশ স্টেনসিল লাগবে এবং একই কাপড় বা কাগজের উপর আলাদা আলাদা ভাবে প্রিন্ট করতে হবে।
স্ক্রীন প্রিন্টিং কেন করা হয়?
স্ক্রীন প্রিন্টের ব্যাপক জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এর ছাপ অনেক উজ্জ্বল হয়, এমনকি গাঢ় রংয়ের কাপড়ের উপরও। এছাড়া নকশার কালি বা রং কাপড়ের উপর আলাদা স্তরের সৃষ্টি করে, যা প্রিন্টকে শৈল্পিক করে তোলে। অনেকটা এমবোস প্রিন্ট এর মতো।
এছাড়া, একটি মেশ স্টেনসিল তৈরী হয়ে গেলে তা থেকে যতবার খুশি নকশা কাপড়ে বা কাগজে ফেলা যায়। অর্থ্যাৎ, একই নকশা বার বার ব্যবহার করতে একটি মেশই যথেষ্ঠ। অনেক বেশী প্রিন্ট করতে, যেমন ইউনিফর্ম তৈরীতে বা খেলোয়ারদের পোশাক তৈরীতে স্ক্রীন প্রিন্টিং খুবই সুবিধাজনক।
একাধিক রংয়ের নকশা করা যদিও স্ক্রীন প্রিন্টিং এ সময়সাপেক্ষ ও জটিল, দক্ষ শিল্পীর হাতে স্ক্রীন প্রিন্ট এ যে শৈল্পিক নকশা ওঠে, তা ডিজিটাল প্রিন্টারে সম্ভব নয়।
স্ক্রীন প্রিন্ট তৈরীর ধাপগুলো কি কি?
স্ক্রীন প্রিন্টের যত পদ্ধতি আছে, তার সবগুলোর মূল ধাপগুলো একই। আজ যে পদ্ধতি আমরা জানবো, তা মূলত আলোক সংবেদনশীল পদার্থ দিয়ে তৈরী মেশ ব্যবহার করে প্রিন্ট করা। এই পদ্ধতিতে তৈরী স্টেনসিল অনেক নিখুঁত এবং জটিল থেকে জটিলতর নকশার স্টেনসিল তৈরী করা যায়। ধাপসমূহঃ
১. নকশা তৈরীঃ প্রথমেই নকশাটা একটা স্বচ্ছ ফিল্ম এর উপর সাদা-কালো প্রিন্ট করিয়ে নিতে হবে। এজন্য কম্পিউটারে গ্রাফিক্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে তা স্বচ্ছ ফিল্ম এর উপর প্রিন্ট করা সবচেয়ে সুবিধাজনক। এই ফিল্ম দিয়েই আমরা স্টেনসিল মেশ তৈরী করবো। রঙ্গিন প্রিন্ট এর জন্য একই মাপের একধিক ফিল্ম তৈরী করতে হবে এবং প্রতিটি ফিল্ম একটার উপর আরেকটা বসালে যেন একটি সম্পূর্ণ ছবি পাওয়া যায়।
২. মেশ তৈরীঃ নকশার ধরণ ও যার উপরে নকশা বসবে তা অনুযায়ী একটা মেশ বা জালির মাধ্যম নির্বাচন করতে হবে। আগে মেশ তৈরী হতো রেশম সুতা থেকে যার কারণে এই পদ্ধতিকে সিল্ক স্ক্রীন প্রিন্ট বলা হয়। তবে এখন বেশী ব্যবহার হয় পলিয়েস্টার কাপড়। যার উপর প্রিন্ট বসবে, তার উপর ভিত্তি করে সুতা মোটা বা চিকন করার মাধ্যমে সঠিক মেশ নির্বাচন করতে হয়। মেশটি একটি চারকোনা ফ্রেমের উপর টান টান করে সেট করতে হবে। তার উপর আলোক সংবেদনশীল পদার্থের একটা প্রলেপ দিতে হবে। এই পদার্থ উজ্জ্বল আলোতে তরল হতে কঠিন রুপ ধারণ করে, অর্থ্যাৎ শক্ত হয়ে যায়।
৩. মেশ এর উপর উজ্জ্বল আলো ফেলাঃ এবার প্রিন্ট করা স্বচ্ছ ফিল্মটি মেশ এর উপর বসিয়ে উপর থেকে উজ্জ্বল আলো ফেলা হয়। ফিল্মের যেখানে সচ্ছ, সেখান দিয়ে সংবেদনশীল পদার্থের উপর আলো পড়ে এবং তা শক্ত হয়ে যায়। আর যে অংশটি কালো রংয়ে ঢাকা সে অংশের পদার্থ তরলই থাকে। অনেকেই দেখে থাকবেন যে, রাবার সিল একই পদ্ধতিতে তৈরী করা হয়।
৪. মেশ থেকে স্টেনসিল তৈরীঃ একটি নির্দিষ্ট সময় আলোকপাত করার পর মেশটি পানিতে বা বিশেষ তরলে ধোয়া হয়। ক্ষেত্র বিশেষে ব্রাশ দিয়ে হালকা ঘষাও দিতে হয়। এতে, তরল পদার্থ গুলো ধুয়ে যায় এবং থেকে যায় মেশ এর উপর কাঙ্খিত নকশার নেগেটিভ। এরপর এটিকে শুকিয়ে স্টেনসিল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রঙ্গিন প্রিন্ট এর জন্য বানানো ফিল্ম থেকে একধিক স্টেনসিল একই পদ্ধতিতে বানাতে হবে।
৫. স্টেনসিল থেকে প্রিন্ট করাঃ এবার স্টেনসিলটি একটি প্রিন্টিং প্রেসে সেট করা হয়। নীচে রাখা হয় যার উপর নকশা বসবে তা। এটা কাপড়, ক্যানভাস, কাগজ, কাঠ, কাঁচ বা রং বসে এমন যে কোন বস্তুই হতে পারে। এরপর স্টেনসিলটি কাপড় বা যা রাখা হয়েছে, তার উপর চাপ দিয়ে আটকে স্টেনসিলের উপর কালি বা রংয়ের প্রলেপ দেয়া হয়। স্টেনসিলের যে অংশটিতে অসংখ্য ছিদ্র থাকে, সেখান দিয়ে কালি বা রং ঐ কাপড় বা বস্তুর উপর বসে যায়। বারবার একই পদ্ধতিতে একই নকশা এক বা একাধিক কাপড়ের উপর এভাবে ফেলা হয়। অপরদিকে, রঙ্গিন প্রিন্টের জন্য একই কাপড়ের একই স্থানে প্রতিটি স্টেনসিল বসিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের প্রলেপ দিতে হবে।
৬. স্টেনসিল সংরক্ষণ ও প্রিন্ট শুকানোঃ প্রিন্টের কাজ শেষ হলে এই স্টেনসিল এক প্রকার বিশেষ তরলে ধোয়া হয় যেন তা অন্য কালি বা রং এর জন্য ব্যবহার উপযোগী থাকে। অপরদিকে, কাপড় বা বস্তুটির রং শুকিয়ে গেলে প্রিন্টের কাজটিও শেষ হয়।
আপনারা স্ক্রীন প্রিন্ট দেখতে চাইলে ওয়েবে সার্চ দিয়ে প্রচুর ভিডিও পাবেন। বিয়ের, জন্মদিনের কার্ড, কার্টনের উপর লোগো, বিভিন্ন পণ্যের উপর প্রস্তুতকারকের নাম ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে ছাপাতে স্ক্রীন প্রিন্ট একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি।