ঘুম মহান সৃষ্টিকর্তার অনেক বড় এক নেয়ামত। শয়নের আগে ঘুমানোর দোয় আমাদের সকলেরেই জেনে নেওয়া দরকার যাতে সময়মত তা পাঠ করা যায়।

ঘুমের সমস্যা আমাদের অনেকের মাঝেই খুব কমন একটি ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।  যারা এই সমস্যায় আক্রান্ত, তারাই কেবল এর প্রয়োজনীয়তা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পারে।  ঘুম না আসার কারণ খুজতে গিয়ে পেরেশান হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক একটি ঘটনা।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপ, টেনশন, কাজের ব্যস্ততা ইত্যাদি কারণে ঘুমের অনিয়ম দেখা দেয়। আর এভাবে অনিয়ম চলতে চলতে এক সময় ইহা একটি প্রধান সমস্যায় পর্যবসিত হয়।

তখন, ঘুম আসার উপায় খুজতে গিয়ে ঘুমানোর দোয়া দোয়া থেকে শুরু করে ঘুমের ঔষধ পর্যন্ত অনেক পথই তারা বেছে নিতে হয়।

কারণ, অপর্যাপ্ত ঘুম হলে দিনের বেলায় কাজের খুব ব্যাঘাত ঘটে, তন্দ্রাচ্ছন্নতার দিন অতিবাহিত হয়।

আবার কেউ কেউ এমন আছে যারা অতি নিদ্রার কারণে ঘুম কমানোর উপায় নিয়ে চিন্তিত। মহান আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের প্রতিটি মানুষকেই মাটি দিয়ে বানিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে কি এমন অপার কুদরত লুকিয়ে আছে যার ফলে এক এক মানুষের বৈশিষ্ট এক এক রকম।

যাহোক, আজকের আলোচনায় আমি ঘুম না আসার কারণ, ঘুমের দোয়া ও ঘুম থেকে উঠার, ঘুম না আসলে করণীয়, ঘুমের ঔষধের নাম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলব।

তো, চলুন শুরু করি। প্রথমেই জেনে নেই – ঘুম কেন এত গুরত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় একটি বিষয়।

ঘুম কেন প্রয়োজন?

ঘুম আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। পরিমানমত ঘুম না হলে দিনটা কেমন যেন অস্বস্তিকর অবস্থায় কাটে – বলার অপেক্ষা রাখে না।

ঘুম আপনার উৎপাদনশীলত, আবেগের ভারসাম্যতা, মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, সৃজনশীলতা এমনকি আপনার দৈহিক ওজন – ইত্যাদির সাথে ঘুমের একটি সম্পর্ক থাকে।

ঘুম ব্যাতীত অন্য কোন কাজে আপনি এত উপকৃত হবেন না যদিও ঘুমানোর কাজে আপনার কোন পরিশ্রম করতে হয় না।

ঘুম এমন কোন অবস্থা নয় যেখানে দেহ স্তব্ধ হয়ে যায়। বরং, আপনি যখন ঘুমান, তখন আপনার মস্তিষ্ক ব্যাস্ত থাকে, আপনার দেহের বায়োলজিক্যাল ভারসাম্য আনতে কাজ করে, পরের দিন ঘুম থেকে উঠার পর আপনাকে কাজের উপযোগী করে গড়ে তুলে।

আপনার ঘুমে যদি ব্যাঘাত ঘটে তাহলে পরের দিন স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে দাড়ায়। এভাবে নিয়মিতভাবে যদি ঘুম নষ্ট হতে থাকে তাহলে এক সময় তা মানসিক সমস্যা পর্যন্ত গিয়ে দাড়াবে।

দৈনিক কতটুকু ঘুমানো প্রয়োজন?

সঠিকভাবে দৈনন্দিন কার্য সম্পাদনের লক্ষ্যে প্রতিদিন কোন ব্যক্তির পক্ষে কতটুকু ঘুমানো প্রয়োজন এবং এর বিপরীতে বাস্তবিক অর্থে কি পরিমান সময় সে ঘুমায় – এই দুই এর মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর মতে কোন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে গড়ে দৈনিক প্রায় সাত ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন।

যদিও বর্তমান কর্মমুখর সমাজে আপনি যদি কমপক্ষে ছয় ঘন্টাও ঘুমোতে পারেন – তাও শুনতে ভাল শুনাবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে আমাদের দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমের অপর্যাপ্ততা লক্ষণীয় ভাবে দেখা যাচ্ছে।

অপরদিকে, ঘুমের পরিমান ব্যক্তি ভেদে কিছুটা কম বেশী হতে পারে। স্বাস্থ্যবান মানুষের ক্ষেত্রে অনেক সময় ৭-৯ ঘন্টা ঘুমানোর বিষয়টিও দেখা যায় যাতে তাদের থেকে দিনের সর্বোচ্চ কাজ আদায় করা যায়।

শিশু ও কৈশরে উপনীত মানুষের বেলায় এর পরিমান কিছুটা বেড়ে যায়। আবার বয়স্কদের বেলায় ঘুমের পরিমান কমে যায়।

যাহোক, স্লিপ ফাউন্ডেশন এর সুত্র মতে নিচের টেবিলে বয়সভেদে একজন মানুষের দৈনিক কতটুকু ঘুমানো প্রয়োজন তা উল্লেখ করা হলো-

বয়সযতটুকু ঘুমানো উচিত
সদ্যজাত শিশু০-৩ মাস১৪-১৭ ঘন্টা
শিশু৪-১১ মাস১২-১৫ ঘন্টা
বাড়ন্ত শিশু১-২ বছর১১-১৪ ঘন্টা
প্রি-স্কুল৩-৫ বছর১০-১৩ ঘন্টা
স্কুলে যাওয়া শিশু৬-১৩ বছর৯-১১ ঘন্টা
কিশোর১৪-১৭ বছর৮-১০ ঘন্টা
তরুণ প্রাপ্ত বয়স্ক১৮-২৫ বছর৭-৯ ঘন্টা
প্রাপ্ত বয়স্ক২৬-৬৪ বছর৭-৯ ঘন্টা
বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্ক৬৫ ও ততোধিক৭-৮ ঘন্টা

ঘুম না আসার কারণ

ঘুম না আসার অনেক কারণ রয়েছে যার মধ্যে স্বাস্থ্যগত সমস্যাও অন্তর্ভুক্ত। চিকিৎসাবিদের মত অনুসারে নিচে অনিদ্রাজনিত কয়েকটি কারণ উল্লেখ করছি-

১. এলার্জি এবং শাষ-প্রশ্বাসে সমস্যা থাকলে:

আপনার শ্বসন তন্ত্রের উপরিভাগে কোন সংক্রমণ থাকলে বা ঠান্ডা ও এলার্জি জাতীয় সমস্যা দেখা দিলে রাতের বেলায় ঘুম আসার প্রতিবন্ধকত হিসাবে কাজ করে। ঘুমানোর সময় যদি ঠিকমত শ্বাস না নেওয়া যায় তাহলে সহজেই বিষয়টি অনুমেয় হয়।

২. বার বার ইউরিনেশন:

এই রোগটির নাম নকচুরিয়া যার ফলে বার বার পেসাব করতে হয়। ঘুমিয়ে যাওয়ার পর পরই যদি টয়লেটে যাওয়ার জন্য উঠতে হয় তাহলে আপনার ঘুমও নষ্ট হয়ে যাবে। আপনার দেহে যদি হরমন জাতীয় পদার্থে ভারসাম্য না থাকে অথবা যদি মুত্র নালীতে কোন সমস্যা থাকে তাহলে এই অবস্থার তৈরি হয়।

৩. দীর্ঘ মেয়াদি ব্যথায় জর্জরিত হলে:

আপনার দেহের কোন স্থানে যদি ব্যথা লেগে থাকে তাহলে ঘুমানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাড়ায়। এমনকি যদি আপনি ঘুমিয়েও পরেন, তারপরও আপনার দেহের বিদ্যমান ব্যথা আপনাকে জাগিয়ে তুলবে।

যে সব রোগের কারণে এমন ব্যথা হয় তা নিম্নরুপ-

  • আর্থাইটিস
  • Chronic fatigue syndrome
  • মাথা ব্যথা
  • Inflammatory bowel disease
  • পিঠে বা ঘারে ব্যথা, ইত্যাদি।

৪. চাপ ও বিষন্নতা:

আপনি যদি কোন বিষয়ে চাপ বা মানসিক অশান্তি অনুভব করেন বা বিষন্নতায় আচ্ছন্ন থাকেন তাহলে আপনার ঘুমের উপর তা প্রভাব ফেলবে। এছাড়া, দুঃস্বপ্ন, ঘুমে কথা বলা ও ঘুমের মধ্যে হাটা-চলা করা – ইত্যাদিও অবস্থাও ঘুম নষ্টের কারণ।

ঘুম আসার উপায়

ঘুম আসার উপায় বা ঘুম না আসলে করণীয় বিষয় কি হতে পারে তা নিয়ে আমরা বিভিন্ন রকম চেষ্টা করে থাকে। স্বাস্থ্যগত সমস্যা যা উপরে বর্ণিত হয়েছে – এর ক্ষেত্রে আপনি চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করুন।

এর বাইরেও নিচের কাজগুলো নিয়মিত করতে পারেন-

১. ঘুম না আসার কো মেডিক্যাল কারণ থাকলে তা খুঁজে বের করুন। যেহেতু শারীরিক ও মানসিক উভয় কারণই এর জন্য দায়ী। এছাড়া, সুনির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনের ফলেও ঘুমের অসুবিধা তৈরি হতে পারে।

২. ঘুমানো জন্য দৈনিক একটি সময় বেধে নিন। এর ফলে, আপনার বায়োলজিক্যাল ঘড়িটি সক্রিয় হবে। তবে, বন্ধের দিনও সেই একই রুটিন অনুসরণ করতে হবে।

৩. নিয়মিত শরীর চর্চায় অংশ নিন। শরীর চর্চার ফলে ঘুম না আসার কারণ হিসাবে চিহ্নিত কিছু কিছু বিষয় দুর হয়ে যায়। দৈনিক কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। তবে, তা যেন ঘুমানোর ঠিক আগে না হয়।

৪. যদি আপনি এমন কোন কাজে জড়িত থাকেন যা আপনাকে রাতে জাগিয়ে রাখে তাহলে স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা কিভাবে করতে হয় তা জানুন ও শিখুন।

৫. ঘুমানোর পরিবেশ উন্নত করুন। আপনার শোয়ার ঘরটি যেন অন্ধকার, শান্ত এবং নীরব অবস্থা বিরাজ থাকে – তা নিশ্চিত করুন।

ঘুমানোর দোয়া

আপনি যদি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে থাকেন তাহলে ঘুম আসার দোয়া শিখে নিন এবং তা ঘুমানোর পূর্বে নিয়মিত পাঠ করুন।

ঘুমানোর দোয়া ছাড়া ঘুমানোর পূর্বে আরোও কিছু আমল রয়েছে যা নবী (সাঃ) আমাদের শিখিয়েছেন তা আমলে আনার চেষ্টা করুন।

হাদিসের ভাষ্য মোতাবেক, ঘুম হলো মৃত্যুর ভাই। তাহলে, নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন আপনি কেমন মৃত্যু আশা করেন? আপনি কি চান, ওজু অবস্থায়, কালেমা পড়তে পড়তে আপনার মৃত্যু হোক?

যদি তাই চান, তাহলে, ঘুমানোর পূর্বে খুব ভাল করে ওজু করে নিন। এর পর, কমপক্ষে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিন। এবার বিছানায় গিয়ে ঘুমের দোয়া পড়ে ডান কাতে শুয়ে পরুন।

ঘুমানোর দোয়া

শোয়ার পর ঘুম না আসা পর্যন্ত নিজে নিজে অনুভব করুন, মৃত্যুর পর মহান সৃষ্টি কর্তার নিকট আপনার সাক্ষাত কেমন হবে। কারণ, ঘুমকে মৃত্যুর ভাই বলা হয়েছে। তাই, ভাল-মন্দ সকল কাজের হিসাব করতে থাকুন এবং এস্তেগফারে মশগুল থাকুন।

এভাবে কিছু সময় পর আশা করা যায়, মহান সৃষ্টি কর্তার অনুগ্রহে ঘুম এসে পড়বে।

আর একটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, এশার নামাজ যেন কোন অবস্থাতেই মিস না হয়ে যায়। কারণ, ইসলামি দৃষ্টিকোন থেকে, এশার নামাজের সাথে শান্তিপূর্ণ ঘুমের একটি যোগসুত্র আছে।

ঘুমের ঔষধের নাম

যদি আপনার স্বাস্থ্যগত কোন সমস্যা থাকে যার কারণে ডাক্তার আপনাকে ঘুমের ঔষধ খেতে পরামর্শ দেয়; একমাত্র তখনই যেন ঘুমের ঔষধ খাওয়া হয়। এর বাইরে কোন অবস্থা তা যেন না হয়।

ঘুমের ঔষধের নাম আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিন। কেননা, কয়েক ধরণের এবং বিভিন্ন মাত্রার ঘুমের ঔষধ রয়েছে। আপনার জন্য কোনটি প্রযোজ্য তা ডাক্তারই সঠিকভাবে বলে দিতে পারবেন।

নিচে কয়েকটি ঘুমের ঔষধের নাম উল্লেখ করা হলো-

  • মেলাটনিন
  • ডায়াজিপাম
  • সুভোরেক্সান্ট
  • জলপিডেন্ট
  • ক্লোনাজিপাম

ঘুম থেকে উঠার দোয়া

উপসংহার

ঘুমানোর দোয়া আমাদের ইসলাম ধর্মের চর্চার একটি অংশ। শোয়ার আগে দোয়াটি পড়ে নিলে হুজুর (সাঃ) এর একটি সুন্নতের উপর আমল করা হলো। আবার, আপনি ঘুম থেকে উঠার পর আর একটি দোয়া যদি পড়ে নেন, তাহলে আর একটি লাভ হল। ছোট ছোট এই আমলগুলো করতে পারলে, আখেরাতের পাশাপাশি দুনিয়ার জগতেও উপকৃত হওয়া যায়।