Last updated on April 19th, 2024 at 10:48 am

ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা সম্পর্কে আমাদের প্রথামিক ধারণা আছে। সমস্যা হলো মেনে চলা নিয়ে। ক’জন এমন পাওয়া যাবে যারা নিয়মিতভাবে মেনে চলছে। এর জন্য প্রয়োজন রোগটির উপর জনসমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। যার অংশ হিসেবেই আলোচ্য পোষ্ট এর উপস্থাপনা।

ডায়াবেটিস রোগ -এ আক্রান্ত হলে আপনাকে যে না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হবে বিষয়টি তা নয়।  বরং এর উদ্দেশ্য হলো খাদ্য গ্রহনের মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখা। আর এই ভারসাম্যতা ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা তৈরির মাধ্যমেই করতে হবে।

একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জন্যও দৈনিক কত ক্যালরি খাদ্য গ্রহন প্রয়োজন– তার হিসাব জানতে হবে। কারণ ক্যালরি গ্রহণ ও ক্যালরি খরচ দু’টির ব্যবধান বেশী হলে আপনার স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিবে। আর ডায়াবেটিস এর রোগী হলেতো কোন কথাই নেই।

চিনি বা শর্করা জাতীয় খাদ্য রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেও এ জাতীয় খাদ্য আপনার খাদ্য তালিকায় অবশ্যই রাখতে হবে। আসল বিষয় হচ্ছে তা যেন অন্যান্য খাদ্যের সাথে নির্দিষ্ট মাত্রায় আনুপাতিক হারে হয়।

এজন্য, ডায়াবেটিস রোগীর বেলায় গুরত্বপূর্ণ হলো সম্পূর্ণ খাদ্যে শর্করা জাতীয় খাদ্যের পরিমান আনুপাতিক হারে নির্ধারণ করা। শরীরে শর্করা জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন তার দৈহিক কাঠামো, দৈনিক পরিশ্রমের মাত্রা, মেডিকেশন ইত্যাদি।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী হিসাবে শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ি ঔষধ সেবনই যথেষ্ট নয়। যদি ঔষধ গ্রহনের সাথে সাথে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা মেনে না চলেন, তাহলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

কারণ ঔষধ সেবনের মাধ্যমে একদিকে যেমন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাবে একই সাথে অনিয়ন্ত্রিত খাবার খেলে তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।এজন্য ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা তৈরি করে তা মেনে চলা প্রত্যেকের জন্য জরুরী।

এর সাথে সাথে আপনাকে শারীরিক কর্মকান্ডেও অংশ নিতে হবে। আপনার রক্তে কি পরিমান সুগার রয়েছে তা প্রথমে জানতে হবে। সে অনুযায়ী খাদ্য, পানীয়, শরীর চর্চা ইত্যাদির মধ্যে একটি ভারসাম্যতা বজায় রাখতে হবে।

আপনি কি ধরণের খাদ্য খাবেন, কতটুকু খাবেন, দিনে কত বার ও কখন খাবেন – এই সবকিছুই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞগণ ব্যক্তি চাহিদার ভিত্তিতে শর্করা জাতীয় খাদ্যের সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন সুপারিশ করেছে। যেমন, খাওয়ার সময় প্লেটের এক চতুর্থাংশের বেশী শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ না করা – যা ডায়াবেটিসের রোগীতো বটেই, সুস্থ মানুষের জন্যও প্রযোজ্য।

অ্যামেরিকান ডায়াবেটিস এসোসিয়েশনের মতে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্যের বৈশিষ্ট নিম্নরুপ হওয়া উচিত:

  • খাদ্যে ফল ও সবজি অন্তর্ভুক্তিকরণ;
  • চর্বিহীন আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ;
  • ঐ সব খাদ্য বাছাইকরণ যেখানে সুগার কম থাকে;
  • Trans fats পরিহার করা;

আলোচ্য পোষ্টে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকার মধ্যে ৯ ধরণের খাদ্য নিয়ে কথা বলব। এরপর খাদ্য পরিকল্পনার মাধ্যমে ডায়াবেটিস রোগির খাদ্য তালিকা কিভাবে তৈরি করা যায় তার কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।  চলুন, শুরু করা যাক।

ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা

ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিক : ৯টি খাদ্য

নিচের এই খাদ্যগুলো দিয়ে আপনি ক্যালরি হিসাব করে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা তৈরি করতে পারেন। যেখানে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক যে পরিমান ক্যালরি লাগে তার চেয়ে বেশি না হয়।

আপনার দৈনিক কত ক্যালরি প্রয়োজন তা জানার জন্য লিংকে ভিজিট করুন। সেখানে আপনার উচ্চতা, দৈহিক ওজন ও বয়স বসিয়ে দৈনিক ক্যালরির পরিমান জেনে নিতে পারেন।

এছাড়াও নিচে The Plate Method নামে আরেকটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যা থেকে আপনি খাদ্য পরিকল্পনার মাধ্যমে কিভাবে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা তৈরি করা যায় সে বিষয়ে ধারণা পেতে পারেন।

সবুজ পাতা বিশিষ্ট শাক-সবজি:

সবুজ পাতাওয়ালা সবজির মধ্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ লবন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান পর্যাপ্ত পরিমানে পাওয়া যায়। রক্তে সুগারের মাত্রা বৃদ্ধিতে তাদের সর্বনিম্ন পর্যায়ের প্রভাব থাকে।

সবুজ পাতাযুক্ত সবজি যেমন পালং শাক এবং পাতা কপি হল পটাসিয়াম, ভিটামিন-এ এবং কেলসিয়ামের উদ্ভিদজাত উৎসের মধ্যে প্রধান উৎস। সেখানে আমিষ এবং ফাইবারও পাওয়া যায়।

সবুজ পাতাযুক্ত শাক-সবজিতে  বেশী পরিমানে এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং স্টার্চ জাতীয় খাদ্য হজমের জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম থাকে। তাই, কোন কোন গবেষকের মতে এই ধরণের সবজি খেলে ডায়াবেটিস রোগীদের উপকার হয়।

এরকম কয়েকটি সবজির নাম হল-

  • পালং শাক;
  • পাতা কপি;
  • Collard greens;
  • বাধা কপি;
  • Broccoli, ইত্যাদি।

একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, পাতা কপির রস রক্তে সুগারের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। একই সাথে উচ্চ রক্তচাপ কামাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই গবেষণা পদ্ধতি অনুযায়ি রোগীকে দৈনিক ৩০০ মিলিলিটার করে এই পাতা কপির রস ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত খেতে হবে।

আপনারা ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকায় এই ধরণের সবুজ শাক-সবজি অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এর সাথে lean protein জাতীয় খাদ্যও যোগ করা যায়।

পুরো শস্য দানা বা whole grain:

খাদ্য শস্যের পরিপূর্ন অংশ বা whole grain বলতে প্রকৃত অর্থে কি বুঝায় সে সম্পর্কে প্রথমেই ধারণা থাকা প্রয়োজন। যেমন ধরুন আমাদের প্রধান খাদ্য শস্য হল ধান ও গম। গমের কথাই ধরি – এই গমকে খাওয়ার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য কৃষক জমি থেকে উৎপাদিত গম ঘরে তোলে।

এরপর তা ভাল করে শুকিয়ে নিয়ে গম ভাঙ্গার মেশিনের সাহায্যে আটা তৈরি করে। যা আমাদের খাওয়ার উপযুক্ত হয়। এখন কেউ যদি মেশিন থেকে ভাঙ্গানোর পর এই আটা অতি সুক্ষ্ম কোন ছাকনির সাহায্যে ছেকে নেয় তাহলে সেখান থেকে ফাইবার পৃথক হয়ে যায়।

অথচ এই খাদ্যে উপস্থিত এই ফাইবারই ডায়াবেটিস রোগীর উপকারে আসে। ফাইবার ছাকনির সাহায্যে পৃথক হয়ে যাওয়ার কারণে তা আর তখন পূর্নাঙ্গ গমের শস্য দানা থাকল না। আশা করি এখন whole grain কথাটির অর্থ পরিস্কার হয়েছে।

অনুরুপ ঘটনা ধানের ক্ষেত্রেও ঘটে। অনেক ভোজন বিলাসী মানুষ এমন আছে যারা শুধু স্বাদের কারণেই খাদ্য শস্য থেকে বিদ্যমান ফাইবার পৃথক করে খাওয়াকে পছন্দ করে। যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

তবে, চালের ক্ষেত্রে যেহেতু ছাঁকার সুযোগ নেই, এখানে অটো রাইস মিলের কিছু বিশেষায়িত ক্রিয়া থাকে যার মাধ্যমে ধান থেকে চাল বের করার পর এই চাল থেকে পুনরায় এর আবরণ কেটে ফেলার মাধ্যমে চালকে আরোও মসৃন করে এর বাদামি অংশকে ছেটে ফেলা হয়। ফলে অবশিষ্ট চালের অংশে ফাইবারের পরিমান কাংখিত মাত্রায় থাকেনা।

যাহোক, কথা লম্বা হয়ে গেল। আলোচ্য বিষয় ইহাই যে, আমাদের খাদ্য শস্যের whole grain খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। Whole grain – এ উচ্চ মাত্রায় ফাইবার বিদ্যমান থাকে এবং সেখানে আরোও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও উপস্থিত থাকে।

উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অনেক উপকারি হয়। কারণ, খাদ্যে ফাইবারের উপস্থিতি হজম প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে ফলে অন্ত্র থেকে সুগার শোষনের মাত্রা কমে যায় যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

সম্পূর্ণ গম এবং সম্পূর্ণ চালে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) সাদা আটা ও সাদা চাল থেকে অপেক্ষাকৃত কম থাকে। এর অর্থ হল রক্তে গ্লুকোজের উপর তাদের প্রভাব কম থাকে।

খাদ্যে whole grain অন্তর্ভূক্ত করার কয়েকটি ভাল উদাহারণ হল:

  • বাদামি রঙের চাল;
  • বাদামি রঙের আটা;
  • Whole-grain pasta;
  • Buckweat;
  • Quinoa;
  • Millet;
  • Bulgur;
  • Rye; ইত্যাদি।

চর্বিযুক্ত মাছ:

খাদ্যে চর্বিযুক্ত মাছ বা fatty fish যোগ করার মাধ্যমে খাদ্যকে অধিক স্বাস্থ্যসম্মত করে তৈরি করা যায়। চর্বিযুক্ত মাছে গুরত্বপূর্ণ omega-3 ফ্যাটি এসিড থাকে যাদের eicosapentaenoic acid (EPA) এবং docosahexaenoic acid (DHA) বলা হয়।

আমাদের হৃদপিন্ড এবং মস্তিস্কের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খাদ্যের সাথে নির্দিষ্ট পরিমানে স্বাস্থ্যকর চর্বি গ্রহণ করা প্রয়োজন।  American Diabetes Association (ADA) এর মতে যে সব খাদ্যে অসম্পৃক্ত চর্বি থাকে সে সব খাদ্য ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে সুগার এবং লিপিডের পরিমান নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।

যে সব মাছে এই ধরণের চর্বি বেশী পাওয়া যায় তারা হল-

  • সালমন (salmon);
  • ম্যাকেরেল নামিয় সামুদ্রিক মৎস (mackerel);
  • সারডাইনস (sardines);
  • Albacore tuna;
  • Herring;
  • Trout; ইত্যাদি।

আমরা উদ্ভিদজাত বিকল্প উৎস হিসাবে kelp এবং  spirulina জাতীয় সামুদ্রিক শৈবালও খেতে পারি যারা এই ফ্যাটি এসিডের পরিপূরক হতে পারে। এই জাতীয় খাদ্যের সাথে শাক-সবজিও ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকায় রাখা যেতে পারে।

বিনস (beans):

বিনস হল এক প্রকার খাদ্য যা লিগিউমিনাস জাতীয় উদ্ভিদের বীজ থেকে উৎপাদন করা হয়। এরা উদ্ভিদজাত আমিষ জাতীয় খাদ্যের একটি চমৎকার উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয় যা মাছ-মাংসের পুষ্টির বিকল্প হিসাবে কাজ করতে পারে। এই ধরণে উদ্ভিদের বিজ আমিষ জাতীয় খাদ্য উপাদান সরবরাহ করা ছাড়াও এখান থেকে প্রয়োজনীয় কিছু খনিজ লবন যেমন আয়রন, পটাসিয়াম, মেগনেসিয়াম এবং জিংক পাওয়া যায়।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এই বিনস খাদ্য হিসেবে খুব ভাল একটি সুযোগ হতে পারে। উদ্ভিদজাত আমিষ হলে বিনস খাওয়ার ফলে শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহনের পরিমান কমে যায়। বিনের GI স্কেলের মাত্রাও কম থাকে যা রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যান্য খাদ্যের তুলনায় সহায়ক। রক্তে সুগারের সঠিক মাত্রা ধরে রাখতেও বিনস সহায়তা করে।

এছাড়াও, দৈহিক ওজন হ্রাসের লক্ষ্যে বিনসের রয়েছে সক্রিয় ভূমিকা। আপনার রক্তে কোলেস্টেরলসহ এবং উচ্চ রক্ত চাপ কমাতে বিনস কাজ করে।

বিভিন্ন প্রকারের বিনস রয়েছে যেখান থেকে আপনার পছন্দেরটি বাছাই করতে পারেন-

  • পিনটো বিনস (pinto)
  • কিডনি বিনস (kidney)
  • ব্ল্যাক বিনস (black)
  • এডজুকি বিনস (adzuki)
  • নেভি বিনস (navy)

বিনস খুবই বৈচিত্রময় একটি খাদ্য। আপনি বিভিন্ন রকমের বিনস কাচা মরিচের সাথে মিশিয়ে সেদ্ধ করে খেতে পারেন, অথবা রুটির সাথে সালাদ হিসেবেও খেতে পারেন। Canned bean খাওয়ার সময় একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে সেখানে যাতে কোন লবন দেওয়া না থাকে। লবন দেওয়া থাকলে ভাল করে ধুয়ে পরিস্কার করার পর খেতে হবে।

Walnuts বা আখরোট:

আপনি এই বাদাম জাতীয় খাদ্য আপনার খাদ্য তালিকায় যোগ করতে পারেন। মাছের মতই এখানে উপকারি ফ্যাটি এসিড রয়েছে যা আপনার হৃদযন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্য কাজ করে।

এই খাদ্য বিশেষ করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডে সমৃদ্ধ থাকে যাকে alpha-lipoic acid (ALA) বলা হয়। অন্যান্য ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের মত এটিও হৃদপিন্ডের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

ডায়াবেটিস রোগীদের হৃদরোগ বা স্ট্রোক করার উচ্চ ঝুঁকি থাকে। কাজেই এই ধরণের ফ্যাটি এসিড খাদ্যের সাথে গ্রহন করা খুবই প্রয়োজন। ২০১৮ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ি বাদাম জাতীয় এইসব খাদ্য গ্রহনের সাথে ডায়াবেটিস কম হওয়ার একটি যোগসুত্র খুজে পাওয়া যায়।

এছাড়াও, আখরোটে রয়েছে আমিষ, ভিটামিন বি-৬, মেগনেসিয়াম এবং আয়রনের মত প্রধান প্রধান পুষ্টি উপাদান।

আপনি সকালের নাস্তায় পর্যাপ্ত পরিমানে আখরোট সালাদের সাথে মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারেন।

সাইট্রাস জাতীয় ফলমুল:

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, সাইট্রাস জাতী ফল যেমন কমলালেবু, আঙ্গুর, লেবু ইত্যাদির ভিতরে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের প্রভাব রয়েছে। আপনি যদি শর্করা জাতীয় খাদ্য ব্যতিরেকে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এবং খনিজ লবন পেতে চান তাহলে এই ধরণের ফলমুল আপনার জন্য।

কোন কোন গবেষক মনে করেন কমলার ভিতর hesperidin এবং naringin নামে এমন দু’টি বায়োফ্লেভোনয়েড এন্টি অক্সিডেন্ট থাকে যার ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে প্রভাব বিদ্যমান।

এছাড়াও, সাইট্রাস ধরণের ফলমুলে ভিটামিন-সি, ফলেট, পটাসিয়াম ইত্যাদি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়।

বেরিস:

বেরিস এমন ধরণের ফল যা এন্টি অক্সিডেন্ট দিয়ে ভরপুর থাকে যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বা চাপ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের সাথে বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা যেমন হৃদরোগ, কেনসার ইত্যাদির লিংকেজ রয়েছে।

গবেষণায় দেখা যায় যে, যে সব মানুষের ডায়াবেটিস আছে তাদের দীর্ঘ মেয়াদে অক্সিডেটিভ স্ট্রেসে ভুগার রেকর্ড থাকে। শরীরে যখন এন্টি অক্সিডেন্ট এবং ফ্রি-রেডিক্যালস এর ভারসাম্য বজায় না থাকে তখন এই অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি হয়।

ব্লুবেরিস, ব্ল্যাকবেরিস, স্ট্রবেরিস এবং রেস্পবেরিসে প্রচুর পরিমানে এন্টিঅক্সিডেন্টে এবং ফাইবার থাকে। এছাড়াও রয়েছে কিছু গুরত্বপূর্ণ ভিটামিন ও খণিজ লবন, যেমন

  • ভিটামিন-সি;
  • ভিটামিন-কে;
  • পটাসিয়াম;
  • ম্যাঙ্গানিজ, ইত্যাদি।

আপনি দৈনিক সকালের নাস্তায় টাটকা কিছু বেরিস অন্তর্ভূক্ত রাখতে পারেন।

মিষ্টি আলু:

মিষ্টি আলুর GI index গোল আলুর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম। এই কারণে, যেহেতু মিষ্টি আলু ধীরে ধীরে গ্লুকোজ সরবরাহ করার কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্র সহসা বেড়ে যায়না তাই মিষ্টি আলু ডায়াবেটিস রোগীদের পছন্দের তালিকায় আসতে পারে।

মিষ্টি আলু অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানেরও একটি ভাল উৎস, যেমন-

  • ফাইবার;
  • ভিটামিন-এ;
  • ভিটামিন-সি;
  • পটাসিয়াম; ইত্যাদি।

আপনি বিভিন্নভাবে এই মিষ্টি আলু খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারেন। যেমন সেদ্ধ বা রোস্ট করে খেতে পারেন। সুষম খাদ্য তৈরির জন্য মিষ্টি আলুর সাথে lean protein এবং সবুজ পাতাযুক্ত শাক-সবজি এর সাথে যোগ করতে পারেন।

প্রোবায়োটিক ইওগার্ট:

প্রোবায়োটিক হল উপকারি ব্যাক্টেরিয়া যা মানুষের পরিপাক তন্ত্রে বসবাস করে। এই প্রোবায়োটিকস পরিপাকতন্ত্রের সার্বিক সুস্বাস্থ্য বজায় রেখে আমাদের হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। ২০১১ সালের কিছূ গবেষণা প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায় যে, প্রোবায়োটিক ইওগার্ট খেলে কোলেষ্টেরল লেভেল উন্নতি হয় এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিরাময়ের ক্ষেত্রেও এদের ভূমিকা থাকে।

হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রেও এরা কাজ করে বলে মনে করা হয়।

একটি রিভিউ স্টাডির সুপারিশে দেখা যায় যে, প্রোবায়োটিকস খাওয়ার ফলে শরীরের প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমে যায় এবং শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে দেয়।

আপনি প্রকৃতিজাত ইওগার্ট নির্বাচন করে খেতে পারেন যেখানে কোন অতিরিক্ত লবন দেওয়া থাকেনা। প্রোবায়োটিকসে সাধারণত: Lactobacillus বা Bifidobacterium  ব্যাক্টেরিয়ার জীবন্ত সক্রিয় কালচার থাকে

আপনি সকালের একটি সুন্দর নাস্তা উপহার দেওয়ার জন্য ইওগার্টের সাথে বেরিস বাদাম জাতীয় খাবার অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন

ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা তৈরির নিয়ম

ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা কিভাবে তৈরি করতে প্রথমেই আপনার খাদ্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। এর উদ্দেশ্য হল কখন, কতটুকু পরিমানে, কি জাতীয় খাবার খেতে হবে – তা ঠিক করে নেওয়া। যাতে আপনার রক্তে গ্লুকোজ লেভেল নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং একই সাথে আপনার দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদাও মিটে।

একটি সুন্দর ও বাস্তবধর্মি  খাদ্য পরিকল্পনা আপনাকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে।

খাদ্য পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকায় যে সব খাদ্য অন্তর্ভূক্ত থাকতে পারে তা নিম্নরুপ:

  • এমন শাক-সবজি বাছাই করুন যা শ্বেতসার জাতীয় নয় যেমন, ব্রোকলি, পালন শাক, এবং সবুজ শীম ইত্যাদি।
  • পরিশোধিত দানাদার খাবার ও বাড়তি চিনি পরিহার করুন- যেমন, সাদা আটা, সাদা চাউল, চিনি ইত্যাদি।
  • পুরো শষ্য দানা বা whole grain থেকে তৈরি খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করুন।

খাদ্য গ্রহনের সময় আপনি কার্বোহাইড্রেট জাতীয় যে খাদ্য আপনি খান তা হজমের পর দেহে শোষন হয়ে রক্তের গ্লুকোজ লেভেল বাড়িয়ে দেয়। কার্বোহাইড্রেট কত দ্রুত রক্তের গ্লুকোজ মাত্রা বাড়ায় সেটি নির্বর করে আপনি কোন ধরনের কর্বোহাইড্রেট খাচ্ছেন তার উপর।

যেমন, আপনি সম্পূর্ন ফলের পরিবর্তে যদি শুধু তার জুস পান করেন তাহলে আপনার গ্লুকোজ লেভেল তারাতারি বেড়ে যাবে। আপনি যদি ফাইবার সমৃদ্ধ  কার্বোহাইড্রেট খান এবং এর সাথে নির্ধারিত পরিমানে প্রোটিন ও চর্বি যোগ করা যায়, তাহলে আপনার রক্তে সুগার লেভেল দ্রুত বেড়ে যাবে না।

এজন্যই, যথাযথ খাদ্য পরিকল্পনার মাধ্যমে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা তৈরি করা প্রয়োজন।

পরিকল্পনা করে আপনাকে এমন একটি সুষম খাদ্য সাজাতে হবে যা খেলে আপনার গ্লুকোজ লেভেল নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রতিবারের খাবারে একই পরিমান কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করা ডায়াবেটিস রোগির জন্য ভাল।

এবারে আমি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ, USDA কর্তৃক সুপারীশকৃত এমন একটি tool এর নাম বলব যা দিয়ে আপনি  খুব সহজেই ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করতে পারেন। এর নাম হল The Plate Method.

The Plate Method

না জেনে না বুঝে প্রয়োজনের চেয়ে অধিক খাদ্য খাওয়ার ঘটনা আমাদের জীবনে অহরহ ঘটে চলছে। Plate Method খুবই সহজ একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে এটা দৃশ্যমান হয় যে, সঠিক খাদ্য নির্ধারিত পরিমানে খাওয়া হচ্ছে।

যেমন, ডায়েবেটিস রোগির ক্ষেত্রে শ্বেতসার নয় এমন সবজি ও lean প্রোটিন বেশি করে খেতে হয় যা রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এই পদ্ধতি অনুসরণের সময় আপনি ৯ ইঞ্চি আকারের একটি প্লেট নিন এবং এরপর নিম্নলিখিত ভাবে প্লেটে খাদ্য নিন-

  • প্লেটের অর্ধেক অংশ non starchy vegetalbes বা শ্বেতসার নয় এম সবজি দিয়ে ভরে ফেলুন। এমন সবজির উদাহরন হল, সালাদ, সবুচ শীম, ব্রোকলি, ফুলকপি, বাধাকপি, শশা, গাজর ইত্যাদি।
  • প্লেটের একচতুর্থাংশ জায়গায়ে lean protein যেমন চিকেন, টার্কি, beans, তফু বা ডিম রাখুন।
  • প্লেটের অবশিষ্ট পরিমান অর্থাৎ অপর একচতুর্থাংশ জায়গায় কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য রাখুন। যেমন, whole grains, শ্বেতসার জাতিয় সবজি যেমন গোল আলু, মিষ্টি আলু, মটরশুটি, বাদামি চাল, বাদামি আটা, beans ইত্যাদি। এছাড়াও, আপনি কিছু ফল, দুধ ও দই রাখাতে পারেন।

বন্ধুগন, আপনাদের যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্টের মাধ্যমে জানালে আমি উত্তর দিব। ধন্যবাদ।

আরোও দেখুন: ডায়াবেটিস কি, ডায়াবেটিস কেন হয়, এর লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার নিয়ে একটি রিভিউ।

উপসংহার

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদ এর সহায়তায় ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা তৈরি করে তা মেনে চলা প্রত্যেক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে অবশ্য কর্তব্য। কারণ আপনি যদি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হন তবে একটি সময়ে আপনাকে সাফার করতে হবে।

এক এক করে দেহে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হবে। যার মধ্যে কিডনি ফেইলিউর অন্যতম।

তাই চলুন নিজেও সচেতন হই এবং পোষ্টটি সেয়ার করে অপরকেও সচেতন বানাই।